//
//

বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাস ও বিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা কর।

বাংলাদেশের নাটক

বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাস সাহিত্যের অপরাপর শাখার মত সমৃদ্ধি লাভ করতে পারেনি। অবশ্য সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যেও নাটকের দৈন্য সুস্পষ্ট। তবু দেশবিভাগের পর এখানকার সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অগ্রগতির নিদর্শন সহজেই লক্ষযোগ্য; কিন্তু নাটকের বেলায় অনগ্রসরতা পীড়াদায়ক। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা বিভাগপূর্ব কালের ঐতিহ্য অনুসরণ করে যতটুকু অগ্রসর হয়েছে নাটকের পক্ষে ততটুকু সম্ভবপর হয়নি। নাটকের এই অনগ্রসরতার ব্যাপারে মনে করা হয় যে, মঞ্চসম্পর্কে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতার অভাবে এখানকার নাট্যরচনায় আশানুরূপ অগ্রগতি সাধিত হতে পারেনি। ধর্মীয় সংস্কারের পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ দান সম্পর্কে এখানকার সমাজব্যবস্থা অনেকটা অনুদার। নাট্যান্দোলনের সঙ্গে রঙ্গমঞ্চের যোগাযোগ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এখানে জাতীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক রঙ্গমঞ্চের অভাব রয়েছে। ফলে অভিনয় শিক্ষা ও অনুশীলনের প্রয়োজনীয় সুযোগ তেমন নেই। নাটককে জনপ্রিয় করার জন্য তেমন কোন সুসংহত প্রচেষ্টা এখানে এখনও দেখা যায় না। পেশাদার নাট্যগোষ্ঠী বিকাশের জন্য এখানে অনুকূল পরিবেশ্ব অবর্তমান। এতদিন নাট্যাভিনয়ে প্রমোদকরের চাপ পড়েছে। নাটকের প্রকাশনার অসুবিধাও নাটকসৃষ্টির অন্তরায়। তবে এখন এসব অসুবিধা অনেকটা দূর হচ্ছে।

এখানকার নাটকের আবেদন প্রধানত বিনোদনমূলক ছিল বলে জীবনের গভীরে প্রবেশ করার মত কোন বক্তব্য তেমন লক্ষণীয় হয়ে ওঠেনি। নাটক প্রয়োজনার যথেষ্ট কর্মতৎপরতার অভাব এর বিকাশকে করেছে বাধাগ্রস্ত। নাটক অভিনয়ের সঙ্গে জীবনের ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপনেও উৎসাহ দেখা যায়নি। কখনও নাট্যকর্মীর উৎসাহ স্তিমিত হয়ে গেছে উপযুক্ত নাটকের অভাবে।

এসব অসুবিধা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক কালে নাট্যসৃষ্টির পরিবেশ কিছুটা অনুকূল বলে মনে হতে পারে। এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং কেন্দ্রীয় ভাবে ঢাকায় বেশ কয়েকটি বিশিষ্ট পেশাদার নাট্যসম্প্রদায় গড়ে উঠেছে এবং তাদের প্রচেষ্টার ফলে এখানকার নাটকের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। জাতীয় রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত না হলেও ছোটখাট মঞ্চের সমস্যা বিদূরিত হওয়ায় ক্ষীণ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। প্রমোদ করের গ্রাস থেকে নাট্যাভিনয়কে মুক্ত করার কিছু উদ্যোগ এখন অবর্তমান নয়। বাংলা একাডেমির মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ বিদেশী নাটকের অনুবাদ প্রকাশেরও অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে। ফলে বিদেশী শ্রেষ্ঠ নাটকের সঙ্গে এখানকার নাট্যকারগণ কিছুটা পরিচিত। সাম্প্রতিক কালের সমস্যা এখন নাটকে কিছু কিছু উপস্থাপিত হচ্ছে। ফলে এখানকার নাটকে জীবনজিজ্ঞাসার পরিচয় মিলে। আঙ্গিকগত পরীক্ষানিরীক্ষায় নাট্যকারগণ উৎসাহী। এ সমস্ত দিক বিবেচনায় বলা চলে যে, নাট্যসাহিত্য অতিসাম্প্রতিক কালে কিছুটা সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত এখানকার নাটকে ঐতিহাসিক বিষয়ের চেয়ে সামাজিক বিষয় বেশি রূপায়িত হয়েছে। তবে তাতে সমকালীন জীবনের সমস্যা তেমন প্রতিফলিত হয়নি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর নাটকের ইতিহাসে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বিনোদনের সীমানা পেরিয়ে এখানকার নাটকে বক্তব্য এখন স্পষ্ট। মুক্তি সংগ্রামের ক্ষতবিক্ষত জীবনের হতাশাবেদনা আশা-আকাঙ্ক্ষা সুতীক্ষ্ণ সংলাপে অনুরণিত হয়ে উঠছে সাম্প্রতিক নাটকে।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে নাটক রচনা ও অভিনয়ে যথেষ্ট আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। নাট্য আন্দোলন এখন ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণশীল। বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমের চাহিদার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্য এখন সৃষ্টিমুখর। আধুনিক বিশ্বের নাট্যসাহিত্যের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ এখন বেশ ঘনিষ্ট এবং তার প্রভাবে নাট্য রচনা ও অভিনয়ের ক্ষেত্রে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এর সাফল্য এদেশের নাটকে বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি আনয়ন করছে।

বাংলাদেশের অপরাপর সাহিত্য শাখার মত নাটকেও প্রবীণ-নবীনের সমাবেশ শটেছে। প্রবীণেরা সামাজিক ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে নাটক লিখেছেন। নবীনেরা সমকালীন সমস্যা ও আঙ্গিকগত পরিবর্তন নাটকের উপজীব্য করেছেন।

শাহাদাৎ হোসেন 

প্রবীণ নাট্যকারগণের মধ্যে শাহাদাৎ হোসেনের (১৮৯৩-১৯৫৩) নাম উল্লেখযোগ্য। কবি হিসেবে তিনি খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক হিসেবেও তাঁর অবদান রয়েছে। তবে নাট্যসাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব বিদ্যমান। বিভাগপূর্ব যুগে নাট্যরচনায় তিনি হস্তক্ষেপ করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই গতিধারা অব্যাহত ছিল। ‘মসনদের মোহ’, ‘আনারকলি’, ‘সরফরাজ খা’, ‘নবাব আলীবর্দী’ তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক। ঐতিহাসিক কাহিনীর পটভূমিকায় প্রণয়চিত্রের রূপায়ণই নাটকগুলোর উদ্দেশ্য। তিনি কতকগুলো বেতার নাটকও রচনা করেছিলেন। মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতি শাহাদাৎ হোসেনের বিশেষ অনুরাগ ছিল। তিনি তাঁর পরিচয় দিয়েছেন তাঁর নাটকের বিষয়বস্তু নির্বাচনের মাধ্যমে। জাতীয় জীবনে নতুন প্রেরণা সঞ্চারের উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর নাটকে। বিশেষ আদর্শবোধ তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির পেছনে কাজ করেছিল।

ইব্রাহীম খাঁ 

ইব‌্রাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৮) ঐতিহাসিক ও সামাজিক নাটকের রচয়িতা। ‘কামাল পাশা’ ও ‘আনোয়ার পাশা’ নাটকে তুরস্কের নবজনের কথা বলা হয়েছে। নিজেদের জাতীয় জীবনে প্রেরণা সঞ্চারের জন্যও এগুওর বিশেষ লক্ষ্য ছিল। ‘কাফেলা’ তাঁর সামাজিক নাটক। সমাজ জীবনে জাতীয়তাবোধের চেতনা সঞ্চারের লক্ষ্যে তিনি মুসলিম ইতিহাস থেকে বিষয়বস্তু নির্বাচন করেছিলেন। ঐতিহ্য চেতনায় তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। নাটক রচনায় তাঁর এই সমকালীন বৈশিষ্ট্য তিনি অনুসরণ করেছে। ভাষার সরলতা, সহজ বক্তব্য ও রসমধুর সংলাপ তাঁর নাটকের বৈশিষ্ট্য।

আকবর উদ্দিন 

আকবর উদ্দিন (১৮৯৬-১৯৭৮) কতিপয় জনপ্রিয় নাটক রচনা করেছিলেন। তাঁর নাটকগুলোর নাম—‘নাদির শাহ’, ‘সিন্ধুবিজয়’, ‘মুজাহিদ’ ও ‘আজান’। প্রথম তিনটি নাটক ইতিহাসের বিষয়বস্তু অবলম্বনে রচিত। অপর নাটক ‘আজানের’ উপজীব্য সামাজিক বিষয়বস্তু। আকবর উদ্দিন ঐতিহাসিক নাটক রচনার ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। ‘আজান’ নাটকে সামাজিক সমস্যার রূপায়ণ লক্ষণীয়। তাঁর অপর ঐতিহাসিক নাটক ‘সুলতান মাহমুদ’। জাতীয় জীবনের নবরূপায়ণের জন্য তিনি অতীত গৌরবকে তাঁর নাটকের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। সমকালীন সাহিত্যচেতনা তাঁকে প্রেরণা যুগিয়েছিল।

জসীমউদ্‌দীন

কবি হিসেবে জসীমউদ্‌দীনের (১৯০২-৭৬) প্রধান পরিচয় প্রকাশ পেলেও তিনি কয়েকটি নাটকেরও রচয়িতা। তিনি তাঁর কাব্যের মত গ্রামীণ জীবনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তাঁর নাটকে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। তাঁর নাট্যপ্রচেষ্টা তাঁর কাব্যসাধনার বৈশিষ্ট্যের সমগোত্রীয় বলা যেতে পারে। ‘পদ্মাপার’, ‘বেদের মেয়ে’, ‘মধুমালা’, ‘পল্লীবধূ’, ‘ওগো পুষ্পধনু’ প্রভৃতি তাঁর গীতিনাট্য। ‘মধুমালা’য় লোকসাহিত্যের উপাদান স্থান পেয়েছে। অন্যান্য নাটকে গ্রামের মানুষের দ্বন্দ্বসংঘাতের পরিচয় পাওয়া যায়।

আবুল ফজল 

আবুল ফজল (১৯০৩-৮৩) কথাসাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর ‘একটি সকাল’, ‘আলোক লতা’, ‘স্বয়ম্বরা’ প্রভৃতি গ্রন্থ একাঙ্কিকা সঙ্কলন। এসব সাহিত্যসৃষ্টিতে নাটকীয় কলাকৌশলের চেয়ে গাল্পিক বৈশিষ্ট্যই প্রাধান্য পেয়েছে। তবে তাঁর নাটকের মধ্যে সমকালীন জীবনের বিষয়বস্তু উপস্থাপিত হয়েছে। সমাজজীবন প্রতিফলনে তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি।

আযিমউদ্দিন

আযিমউদ্দিন (১৯০৪-৭৩) নাট্যকার হিসেবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত ‘মহুয়া’ নাটকটি লোকসাহিত্যের কাহিনী ভিত্তিক। প্রেমের সুতীব্র আকর্ষণে জীবন বিসর্জনের এক বেদনাতুর কাহিনী এই নাটকের বক্তব্য। ‘মা’ তাঁর অপর বিখ্যাত নাটক। সামাজিক জীবনাদর্শের পরিচয় এতে বিধৃত। আযিমউদ্দিনের অপরাপর নাট্যসৃষ্টি হিসেবে ‘অহঙ্কার’, ‘কাঞ্চন’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

কাজী মোহাম্মদ ইলিয়াস 

কাজী মোহাম্মদ ইলিয়াস (১৯০১) সামাজিক জীবনের সমকালীন সমস্যা নিয়ে নাটক রচনা করেছেন। তাঁর নাটক ‘স্মাগলার’। নাটকটি দেশাত্মবোধ ও সমাজের দুর্নীতি সম্পর্কে রচিত।

নুরুল মোমেন 

সজাগ অনুভূতি, সুতীক্ষ্ণ রসবোধ এবং বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ নাট্যকার নুরুল মোমেনের (১৯০৮-৯০) নাটকের বিশিষ্টতা। ‘রূপান্তর’, ‘নেমেসিস’, ‘যদি এমন হোত’, ‘নয়া খানদান’, ‘আলোছায়া’, ‘এইটুকু এই জীবনটাতে’, ‘যেমন ইচ্ছা তেমন’, ‘শতকরা আশি ইত্যাদি তাঁর নাট্যগ্রন্থ। এছাড়া তাঁর বহু একাঙ্কিকা বেতারে প্রচারিত হয়েছে, অনেকগুলো পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম নাটক ‘রূপান্তর’ প্রকাশের ফলেই নুরুল মোমেন নাট্যকার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তার সর্বাধিক কৃতিত্ব ‘নেমেসিস’ নাটক রচনায়। এক চরিত্রের এই নাটকটি বিশেষ আঙ্গিকে রচিত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সুযোগে গড়ে ওঠা বিত্তশালী জনৈক লোকের মনোজগতের দ্বিধা-সংশয়-দ্বন্দের চিত্র এ নাটকে প্রতিফলিত। অন্যান্য নাটকে নুরুল মোমেন সমাজের সমকালীন সমস্যাদি রূপায়িত করেছেন। তাঁর নাটকের মধ্যে সমকালীন জীবনের চিত্র রূপায়ণের ফলে সেসব যথেষ্ট জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছে। আঙ্গিকের বৈচিত্র্য এবং সংলাপের আকর্ষণীয়তা তাঁর নাটককে বিশিষ্টতা দান করেছে।

আশরাফুজ্জামান

আশরাফুজ্জামান (১৯১১) সমাজের উঁচুনিচু ব্যবধান অবলম্বনে লিখেছেন ‘সয়লাব’ নাটকটি। গল্প উপন্যাস ও অনুবাদের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান রয়েছে।

আ. ন. ম. বজলুর রশীদ

আ. ন. ম. বজলুর রশীদ ১৯১১-৮৬) অনেকগুলো নাটক রচনা করেছেন। সাহিত্যের অপরাপর ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর প্রকাশিত নাটকগুলোর নাম—‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘একে একে এক’, ‘ঝড়ের পাখী’, ‘ত্রিমাত্রিক’, ‘ধানকলম’, ‘যা হতে পারে’, ‘শিলা ও শৈলী’, ‘সুর ও ছন্দ’, ‘মেহের নিগার ও অন্যান্যিকা’ ইত্যাদি। সমকালীন জীবনের চিত্র ও সমস্যা তাঁর নাটকের উপজীব্য।

আলী মনসুর

নাট্যকার আলী মনসুরের (১৯২৫) ‘পোড়োবাড়ী’, ‘বোবা মানুষ’, ‘দুর্নিবার’, ‘শেষ রাতের তারা’ ইত্যাদি নাটক হিসেবে বিশিষ্ট। তাঁর নাটকে গ্রামজীবনের ব্যথা-বেদনার চিত্র রূপায়িত হয়েছে।

ওবায়দুল হক

ওবায়দুল হকের (১৯২২-২০০৭) ‘দিগ্বিজয়ী চোরাকারবারী’, ‘এই পার্কে’, ‘ভোটভিখারী’, ‘ব্যতিক্রম’, ‘রুগ্নপৃথিবী’ প্রভৃতি নাটকে বর্তমান সমাজের বাস্তব সমস্যার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। সমাজের অন্যায় অনাচার সম্পর্কে নাট্যকারের দৃষ্টিভঙ্গি এসব নাটকে প্রকাশ পেয়েছে এবং তিনি সমাজের দোষত্রুটি সংশোধনের জন্য তা স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। সমাজ জীবনের সঙ্গে নাট্যকারের যে সম্পৃক্ততা থাকে তার পরিচয় এসব নাটকে বিদ্যমান। সময়ের প্রয়োজন মিটানোর দিকে নাট্যকারের লক্ষ্য ছিল।

ইব্রাহিম খলিল

ইব্রাহিম খলিল (১৯১৭-৭৪) কয়েকটি ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেছিলেন। তাঁর নাটকগুলোর নাম—‘ফিরিঙ্গীবাজ’, ‘স্পেনবিজয়ী মুসা’, ‘ফিরিঙ্গী হার্মাদ’, ‘সমাধি’ ইত্যাদি। ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রচিত নাটকে জাতীয় জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টির প্রেরণা রয়েছে। জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির প্রেরণা এসব নাটকে লক্ষণীয়।

ফররুখ আহমদ 

ফররুখ আহমদ (১৯১৮-৭৪) ‘নৌফেল ও হাতেম’ নামে একটি কাব্যনাট্য রচনা করেছিলেন। আঙ্গিকের পরীক্ষা হিসেবে গ্রন্থটি বিশিষ্টতার অধিকারী। পুথিসাহিত্যের জনপ্রিয় কাহিনী এখানে নতুন আঙ্গিকে পরিবেশন করা হয়েছে।

সিকানদার আবু জাফর 

সিকানদার আবু জাফর (১৯১৮-৭৫) কবি হিসেবে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। কয়েকটি নাটক রচনায় তাঁর কৃতিত্ব বিদ্যমান। ‘শকুন্তলা উপাখ্যান’ একটি রূপক নাটক। ‘সিরাজদ্দৌলা’ তাঁর ঐতিহাসিক নাটক। জাতীয় চেতনা ঐতিহ্য ও প্রেরণা হিসেবে এখানে কাহিনী নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবেশিত হয়েছে। ‘মহাকবি আলাওল’ জীবনী নাটক। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠকবি আলাওলের জীবনকাহিনী এতে স্থান পেয়েছে। কবির সংঘাতময় জীবনালেখ্য নাটকের উপজীব্য। বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ এসব নাটকের বৈশিষ্ট্য ইতিহাসের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে সত্য উদঘাটনে নাট্যকার এসব নাটকে তৎপর ছিলেন।

শওকত ওসমান 

কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান (১৯১৭-৯৮) নাটক রচনায় বিশিষ্টতা দেখিয়েছেন। তিনি ছিলেন একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ নাট্যকার। সমাজজীবনের বিচিত্র পরিচয় তাঁর নাটকে রূপায়িত হয়ে উঠেছে। শাণিত ব্যঙ্গ তাঁর নাটকের অনুষঙ্গী। তাঁর গল্প উপন্যাসে যেমন সমাজ-জীবনের চিত্র প্রত্যক্ষ করা তেমনি তাঁর নাটকেও সমকালীন জীবনের বিচিত্র সমস্যা রূপায়িত হয়ে উঠেছে। ‘আমলার মামলা’, ‘তস্কর লস্কর’, ‘কাঁকরমণি’, ‘বাগদাদের কবি’, ‘এতিমখানা’, ‘ডাক্তার আবদুল্লার কারখানা’, ‘তিনটি ছোট নাটক’, ‘পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক।

আবদুল হক

আবদুল হক (১৯২০-৯৭) ‘অদ্বিতীয়া’ নাটক লিখে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। বহুবিবাহ সম্পর্কিত সমস্যা অবলম্বনে নাটকটি রচিত। তাঁর অপর নাটক ‘ফেরদৌসী’। বৈচিত্র্যধর্মী প্রতিভার অধিকারী এই নাট্যকার সমকালীন সমাজকে তাঁর নাটকে রূপায়িত করে বাংলাদেশের নাটকের বৈশিষ্ট্যকেই প্রতিফলিত করেছেন। কাহিনী উপস্থাপনায়, ঘটনা বিন্যাসে, চরিত্রচিত্রণে ও সংলাপ রচনায় নাট্যকারের কৃতিত্ব বিদ্যমান। ঐতিহাসিক নাটক হিসেবে ফেরদৌসীর গুরুত্ব। ‘সোনার ডিম’ তার অপর নাটক। তিনি অনেকগুলো ইংরেজি নাটকের বাংলা অনুবাদও করেছেন।

ড. নীলিমা ইব্রাহিম

ড. নীলিমা ইব্রাহিম (১৯২১-২০০২) ‘দুয়ে দুয়ে চার’, ‘নব মেঘদূত’, ‘মনোনীতা’, ‘যে অরণ্যে আলো নেই’, ‘সূর্যাস্তের পর’ নাটকে সমাজের বিচিত্র বৈশিষ্ট্য রূপায়িত করে তুলেছেন। গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, ছোটগল্প, উপন্যাস ও অনুবাদে তাঁর দক্ষতার মত নাটকেও কৃতিত্বের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। সমকালীন জীবনের চিত্রাঙ্কনে তাঁর কৃতিত্ব বিদ্যমান।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-৭১) ‘সুড়ঙ্গ’, ‘বহিপীর’ ও ‘তরঙ্গভঙ্গ’ নাটকের রচয়িতা। তাঁর উপন্যাসের মত নাটকও আঙ্গিকগত দিক থেকে বিশিষ্ট। ‘বহিপীর’ তাঁর পুরস্কৃত নাটক। এতে সমাজজীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকের প্রতিফলন ঘটেছে। সমাজসচেতন নাট্যকার হিসেবে এখানে তাঁর পরিচয় প্রকাশমান। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘তরঙ্গভঙ্গ’ আঙ্গিক পরীক্ষায় একটি সার্থক নাটক। বিষয়বস্তু নির্বাচনে, আঙ্গিক রূপায়ণে ও সংলাপ সংযোজনায় তাঁর বিশিষ্টতা বিদ্যমান। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সংখ্যাধিক্যে নয়, উৎকর্ষে তাঁর কৃতিত্বের যথার্থ পরিচয় দিয়েছেন। বিষয় নির্বাচনে যেমন তিনি অভিনবত্ব দেখিয়েছেন, তেমনি নাটকের আঙ্গিকের অভিনবত্বে তাঁর বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। সমাজের সমস্যা তাঁর নাটকে এসেছে, কিন্তু তা পরিবেশিত হয়েছে গতানুগতিকার বাইরে। এর ফলে নাট্যরসিকের কাছে চমকপ্রদ বলে বিবেচিত হতে পারে।

সৈয়দ আলী আহসান

সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-২০০২) কবি ও সমালোচক হিসেবে পরিচিত। তাঁর। কয়েকটি নাটকও রয়েছে। ‘কোরবানী’, ‘জোহরা ও মুশতারী’, ‘জুলায়খা’ প্রভৃতি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

মুনীর চৌধুরী 

মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-৭১) বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে একটি অত্যুজ্জ্বল নাম হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর নাটকগুলো হচ্ছে—‘রক্তাক্ত প্রান্তর’, ‘চিঠি’, ‘কবর’, ‘দণ্ডকারণ্য’, ‘পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য’। তাঁর কতকগুলো অনুবাদ নাটকও রয়েছে। ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ ইতিহাসের পটভূমিকায় রচিত, কিন্তু তাতে মানবমানবীর হৃদয়বেদনার পরিচয়ই প্রধানভাবে প্রকাশিত। ‘কবর’ নাটকটি ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায় লেখা। উন্নত ধরনের আঙ্গিক এবং তীক্ষ্ণ সংলাপের জন্য বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক হিসেবে এর মর্যাদা। মুনীর চৌধুরীর অন্যান্য নাটকে সমাজজীবনের বিভিন্ন দিকের প্রতিফলন ঘটেছে। বিষয়-নির্বাচনে, চরিত্র-চিত্রণে, সংলাপ রচনায় মুনীর চৌধুরী যে অনন্য দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন তা তাঁকে জনপ্রিয়তা দান করেছে। বাংলাদেশের নাটকের দিক নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর অবদান সর্বাধিক বলে বিবেচনা করা যায়।

আসকার ইবনে শাইখ 

আসকার ইবনে শাইখ (১৯২৫-২০০৯) সমকালীন নাট্যকারগণের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়। তাঁর নাটকগুলো অভিনয়েও সাফল্য লাভ করেছে। তিনি গ্রামজীবন, ধর্মীয় আদর্শ, দেশাত্মবোধক কাহিনী অবলম্বনে নাটক রচনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ‘বিরোধ’, ‘পদক্ষেপ’, ‘বিদ্রোহী পদ্মা’, ‘শেষ অধ্যায়’, ‘দুরন্ত ঢেউ’, ‘প্রতীক্ষা’, ‘অনুবর্তন’, ‘বিল বাওরের ঢেউ’, ‘এপার ওপার’, ‘অনেক তারার হাতছানি’ ইত্যাদি নাটকে সমাজের বিচিত্র বিষয় রূপায়িত হয়েছে। তাঁর অন্যান্য নাটক ‘কর্দোভার আগে’, ‘রাজপুত্র’, ‘রাজা, রাজ্য, রাজধানী’, ‘মেঘলা রাতের তারা’, ‘কন্যা জায়া জননী’ ইত্যাদি। ‘অগ্নিগিরি’, ‘তিতুমীর’, ‘রক্তপদ্ম’ প্রভৃতি তাঁর ঐতিহাসিক নাটক। এগুলোর বিষয় স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনী। অতীত ঐতিহ্যের পটভূমিকায় জাতীয় জীবনের নতুন চেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে নাট্যকার তাঁর নাটকের বিষয় নির্বাচন করেছেন এবং সমকালীন জীবনের চাহিদা মেটানোর ব্যাপারে তৎপরতা দেখিয়েছেন।

আনিস চৌধুরী

আনিস চৌধুরী (১৯২৯-৯০) সমাজসচেতন নাট্যকার। সমাজের নিখুঁত চিত্রাঙ্কনে তাঁর বিশিষ্টতা। তাঁর ‘মানচিত্র’, ‘এলবাম’, ‘চেহারা’’, ‘তবুও অনন্যা’ বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। তাঁর নাটকে মধ্যবিত্ত মানুষের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, দুঃখ দারিদ্র্য ও সংগ্রামী-চেতনা সার্থক ভাবে ফুটে উঠেছে।

ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ 

ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯) কয়েকটি নাটক রচনা করে দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁর নাটকের নাম—‘মায়াবী প্রহর’, ‘মরক্কোর জাদুকর’, ‘ধন্যবাদ’, ‘নিঃশব্দ যাত্রা’’, ‘সংবাদ শেষাংশ’, ‘জোয়ার থেকে বলছি’, ‘হিজল কাঠের নৌকা’, ‘মেঠোফুলের ঠিকানা’, ‘নরকের লাল গোলাপ’, ‘হে সুন্দর জাহান্নাম’ ইত্যাদি। তাঁর কাব্যনাট্যের নাম ‘ইহুদির মেয়ে’, ‘রঙিন মুদ্রারাক্ষস’।

ড. রাজিয়া খান 

ড. রাজিয়া খান (১৯৩৬-২০১১) ‘আবর্ত’ নাটক লিখে সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনটি ‘একাঙ্কিকা’ তাঁর অপর নাটক।

সাঈদ আহমদ

সাঈদ আহমদ (১৯৩১-২০১০) নাটক রচনায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত নাটকের নাম—‘সাঈদ আহমদের তিনটি নাটক’ (কালবেলা, মাইলপোস্ট, তৃষ্ণায়), ‘প্রতিদিন একদিন’, ‘শেষ নবাব’।

জিয়া হায়দার 

জিয়া হায়দার (১৯৩৬-২০০৮) কাব্য ও প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে অবদান রাখলেও নাটক রচনায় তাঁর কৃতিত্ব সর্বাধিক। কয়েকটি মৌলিক নাটক ছাড়াও তাঁর রয়েছে রূপান্তরিত ও অনূদিত নাটক। তাঁর প্রথম নাটক—‘শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ’ (১৯৭০) অভিনবত্বের জন্য সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তাঁর অন্যান্য নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘এলেবেলে’, ‘সাদা গোলাপে আগুন ও পংকজ বিভাস’। তাঁর রূপান্তরিত নাটক ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’, ‘তাইরে নাইরে না’, ‘উন্মাদ সাক্ষাৎকার’, ‘মুক্তি মুক্তি’’। তাঁর অনূদিত নাটক ‘দ্বার রুদ্ধ’, ‘ডক্টর ফস্টাস এ্যান্টিগানে’ ইত্যাদি।

কল্যাণ মিত্র

কল্যাণ মিত্র (১৯৩৯) নাটক রচনা করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তাঁর নাটকের সংখ্যা অনেক। ‘দায়ী কে’, ‘একটি জাতি একটি ইতিহাস’, ‘জল্লাদের দরবার’, ‘মীর জাফর সাবধান’, ‘সূর্যমহল’, ‘অনন্যা’, ‘চোরাগলি মন’, ‘কুয়াশা কান্না’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘পাথরবাড়ি’, ‘শুভবিবাহ’, ‘প্রদীপশিখা’, ‘সোনা রূপা খাদ’, ‘অতএব’, ‘সাগর সেঁচা মানিক’, ‘ডাকাত’, ‘ত্রিরত্ন’, ‘শপথ’, ‘লালন ফকির’ ইত্যাদি কল্যাণ মিত্রের নাটক। সমকালীন বিষয়বস্তু তাঁর নাটকের উপজীব্য। রাজনৈতিক সামাজিক উপকরণ থেকে তিনি নাটকের কাহিনী রূপায়িত করে তুলেছেন। তাঁর নাটকের অভিনয় সাফল্য থেকে জনপ্রিয়তার পরিচয় মেলে।

আবদুল্লাহ-আল-মামুন

আবদুল্লাহ-আল-মামুন (১৯৪-২০০৮) রচিত নাটকগুলো হল—‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘ক্রস রোডে ক্রস ফায়ার’, ‘এখন দুঃসময়’, ‘এবার ধরা দাও’, ‘অরক্ষিত মতিঝিল’, ‘আয়নায় বন্ধুর মুখ’, ‘শপথ’, ‘সেনাপতি’, ‘কোকিলারা’, ‘তোমরাই’, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘চারদিকে যুদ্ধ’, ‘শাহজাদীর কালো নেকাব’, ‘দূরপাল্লা’, ‘তৃতীয় পুরুষ’, ‘আমাদের সন্তানেরা’, ‘তিনটি পথনাটক’, ‘দ্যাশের মানুষ ইত্যাদি।

মমতাজউদ্দিন আহমদ 

মমতাজউদ্দিন আহমদ (১৯৩৫) নাটক রচনায় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। একজন দক্ষ অভিনেতা হিসেবে মঞ্চ সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা নাট্যরচনার কাজে লেগেছে। তাঁর মৌলিক নাট্যরচনার পাশাপাশি রূপান্তরিত নাটক ও নাটকের নবরূপায়ণও রয়েছে। তাঁর মৌলিক নাটক—‘স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা’, ‘ফলাফল নিম্নচাপ’, ‘হরিণ চিতা চিল’, ‘বিবাহ ও কি চাহ শঙ্খচিল’, ‘চয়ন তোমার ভালবাসা’, ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’’, ‘বর্ণচোর’, ‘রাজা অনুরের পালা’, ‘এই সেই কবর’, ‘এই রোদ এই বিষ্টি’, ‘বুড়িগঙ্গার সিলভার জুবিলী’, ‘হৃদয় ঘটিত ব্যাপার স্যাপার’, ‘নাট্যত্রয়ী’, ‘প্রেম বিবাহ সুটকেস’, ‘ক্ষতবিক্ষত’, ‘রঙ্গ পঞ্চদশ’, ‘সাত ঘাটের কানাকড়ি’, ‘রাক্ষুসী’, ‘’আমাদের শহর’, ‘দুই বোন’, ‘পুত্র আমার পুত্র’, ‘দশটি রগড় নাটিকা’, ‘হাস্য লাস্য ভাষ্য’, ‘একই নাটক চার রকম’, ‘তরুকে নিয়ে নাটক’ ইত্যাদি।

সৈয়দ শামসুল হক 

সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫) রচিত ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘গণনায়ক’, ‘নূরলদীনের সারা জীবন’, ‘এখানে এখন’, ‘কাব্যনাট্য সমগ্র’, ‘ঈর্ষা’ ইত্যাদি অভিনয় সফল কাব্যনাট্য।

সেলিম আল-দীন 

সেলিম আল-দীন (১৯৪৮-২০০৮) নাটক রচনায় আঙ্গিক রূপায়ণে ও বিষয়নির্বাচনে নতুনত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে—‘সর্পবিষয়ক গল্প ও অন্যান্য নাটক’, ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’, ‘বাসন’, ‘তিনটি মঞ্চ নাটক’, ‘ঢাকা’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘হরগজ’ ইত্যাদি।

মামুনুর রশীদ 

মামুনুর রশীদ (১৯৪৮) সমকালীন জীবনের চিত্র তাঁর নাটকে বিধৃত করেছেন। তাঁর নাটকগুলো হল—‘ওরা কদম আলী’, ‘ওরা আছে বলেই’, ‘ইবলিশ’, ‘এখানে নোঙর’, ‘খোলা দুয়ার’, ‘অববাহিকা’, ‘গিনিপিগ’, ‘নীলা’, ‘সমতট’, ‘পাথর’, ‘লেবেদফ’ ইত্যাদি।

অনুবাদ নাটক

কবীর চৌধুরী

বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যের আলোচনায় কিছু সংখ্যক অনুবাদ নাটকের কথাও উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে কবীর চৌধুরীর (১৯২৩-২০১১) বিশিষ্ট অবদানের কথা উল্লেখ করা চলে। বিদেশী নাটকের ভাবানুবাদে তাঁর কৃতিত্ব অপরিসীম। ইবসেনের ‘দি এনিমি অব দি পিপল’ নাটকের ভাবানুবাদ ‘শত্রু’ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তাঁর অন্যান্য অনুবাদ নাটক হচ্ছে—ইউজিন ও নীল রচিত ‘সম্রাট জোন্স’, জে. বি. প্রিস্টলীর ‘ডেঞ্জারাস কর্নার’-এর অনুলেখন ‘অচেনা’, ক্রিস্টোফার ফ্রাই-এর ‘টাইগার এট দি গেটস’-এর অনুবাদ ‘হেক্টর’, ইউজীন ও নীলের ‘আহ্ ওয়াইল্ডারনেস’ এর অনুবাদ ‘সেই নিরালা প্রান্তর’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব ছাড়া তাঁর অন্যান্য অনূদিত নাটক হল ‘আহ্বান’, ‘পাঁচটি একাঙ্কিকা’, ‘শহীদের প্রতীক্ষায়’, ‘ছায়া বাসনা’, ‘’অমারজনীর পথে’, ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’, ‘জননী সাহসিকা’, ‘ওথেলো’, ‘গডোর প্রতীক্ষায়’, ‘লিলিস্ট্রাটা’, ‘বিহঙ্গ’, ‘ভেক’, ‘ফেইড্রা’, ‘হ্যামলেট মেশিন’ ইত্যাদি।

মুনীর চৌধুরী 

মুনীর চৌধুরীও অনুবাদ নাটকে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর অনুবাদ হচ্ছে—জর্জ বার্নার্ড শ-র ‘ইউ নেভার ক্যান টেল’-এর অনুবাদ ‘কেউ কিছু বলতে পারে না’, জন গলসওয়ার্দির ‘দি সিলভার বকস’-এর অনুবাদ ‘রূপোর কৌটা’, সেক্সপীয়রের ‘টেমিং অব দি শ্রু’-এর অনুবাদ ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ ইত্যাদি। এছাড়া তাঁর বহু একাঙ্কিকার অনুবাদ পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে আছে।

সৈয়দ আলী আহসান 

সৈয়দ আলী আহসান গ্রীক নাট্যকার সফোক্লিসের ‘ইডিপাস রেক্স’ এর অনুবাদ করেছেন ‘ইডিপাস’ নামে।

আবদুল হক 

আবদুল হক অনেকগুলো বিদেশী নাটকের বঙ্গানুবাদ করেছেন। তাঁর অনুদিত নাটকগুলো হচ্ছে—ইবসেন রচিত ‘ডলস হাউস’-এর অনুবাদ ‘পুতুলের সংসার’, ‘দি মাস্টার বিল্ডার’-এর অনুবাদ ‘মহাস্থপতি’, ‘গোস্ট’ এর অনুবাদ ‘প্রেতাত্মা’, ‘জন গ্যাব্রিয়েল বৰ্কম্যান’, ‘হেডডা গ্যাবলার’, ‘রস মার্সহোম’ ইত্যাদির অনুবাদ।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কৃত ইবসেনের ‘ওয়াইল্ড ডাক’এর-অনুবাদ ‘বুনো হাঁস’, শওকত ওসমান কৃত ‘মলিয়েরের পাঁচটি নাটক’, শাহাবুদ্দিন কৃত আন্তন শেখভের ‘থ্রি সিসটার্স’-এর অনুবাদ ‘তিন বোন’, ‘দি সিগাল’ এর অনুবাদ ‘শঙ্খচিল’, সিকানদার আবু জাফর কৃত ‘সিংগের নাটক’, ইসমাইল মোহাম্মদ কৃত ‘হপ্তম্যানের তিনটি নাটক’, জিয়া হায়দার ও আতাউর রহমান অনূদিত জাঁ-পল সাত্রের ‘দ্বার রুদ্ধ’, মহীউদ্দিন অনূদিত ‘শীলারের ঐতিহাসিক নাটক’, ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান কৃত ও নীলের ‘হেয়ারী এপ’-এর অনুবাদ ‘জাম্বুবান’, আবুল ফজল কৃত গোগলের ‘দি গভর্নমেন্ট ইন্সপেক্টর’-এর অনুবাদ ‘ছদ্মবেশী’, আলী যাকেরের ভাবানুবাদ ‘তেল সংকট ও বিদগ্ধ রমণীকুল’, ‘দেওয়ান গাজীর কিসঙ্গী’ ইত্যাদি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

বাংলা নাটক তার উন্মেষযুগে যে পাশ্চাত্য প্রভাবে প্রভাবিত ছিল, এ যুগেও সে বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। বিশ্বের উন্নত নাট্যসৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের নাট্যসৃষ্টিকে প্রভাবিত করছে এবং এখানকার আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য রূপায়ণে প্রেরণা দিচ্ছে। অনুবাদ নাটকগুলোর গুরুত্ব এভাবেই প্রকাশ পাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!