//
//

ইংরেজি সাহিত্যে নাট্যকার জর্জ বানার্ড শ-এর কৃতিত্ব আলোচনা কর।

জর্জ বার্নার্ড শ’ (১৮৫৬-১৯৫০)

ইংরাজি সাহিত্যের নাটকের ধারায় বার্নার্ড শ’ (১৮৫৬-১৯৫০) এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। তীক্ষ্ণ, প্রত্যক্ষ, নির্মোহ জীবন উপলব্ধি নিয়ে তিনি নাট্যজগতে আবির্ভূত হন। মননশীলতা, প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা, রোমান্টিকতা তথা ভাবাবেগের তীব্র সমালোচনা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে তির্যক সরসতা ছিল তাঁর নাট্যকার সত্তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সামাজিক-অর্থনৈতিক অন্যায় বিচারের প্রতি তাঁর ছিল চিরস্থান সংগ্ৰাম। আর এই সংগ্রামের একমাত্র অস্ত্র ছিল তাঁর নাটক। বিবাহ প্রথা, অমার্জিত বা অসদুপায়ে অর্জিত ধন উপভোগের অনৈতিকতা, ধাযকদের অন্ধ ধর্মবিশ্বাস, যুদ্ধের গৌরব ঘোষণার মধ্যে ধনিক শ্রেণি ও যুদ্ধবাজদের প্রকাণ্ড ফাঁকি, সমাজের মান্যগণ্য নীতিবাগীশদের ব্যক্তিগত জীবনের দুর্নীতির প্রাবল্য ইত্যাদির আলোচনা তিনি সমাজে প্রচলিত ধারণা ও সংস্কারগুলির অন্তঃসারশূন্যতা, তীক্ষ্ণ যুক্তি তর্ক মর্মভেদী ব্যঙ্গের সাহায্যে প্রকট করেছেন।

বার্নার্ড শ’র বুদ্ধির বাক্‌বিন্যাস ও প্রচণ্ড জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে তীক্ষ্ণ শাণিত শায়ক (শর) বর্ষণে সমাজের নিদ্রালু চিত্তকে আহত, রক্তাক্ত ও জাগ্রত করতে চেয়েছেন। তার আক্রমণ মর্মান্তিক কিন্তু অসুন্দর নয়, নীল আকাশ থেকে বজ্রপাতের মতো অকস্মাৎ তার আঘাত আসে সৌন্দর্য বাণীর মধ্যে দিয়ে। তাই বার্নার্ড শ’ কখনও আনন্দ মুখরিত, কখনও গভীর গষ্ঠীর। মেঘ ছেদ করা সৌর্যরশ্মির মতো তাঁর তীক্ষ্ম ভাষণ ও চতুর্পাশ্বস্থ জড়ত্বের আবরণ বিদীর্ণ করে মর্মকে স্পর্শ করে। বার্নার্ড শ’ বিশেষ উদ্দেশ্য প্রচারের জন্যই লেখনী ধারণ করেছেন, নিছক শৈল্পিক আনন্দের জন্য তিনি একছত্রও লিখতে রাজী হননি। তিনি তার্কিক, সমাজ সংস্কারক ও দার্শনিক। কিন্তু তিনি যথার্থই নাট্যশিল্পী। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নাটক রচনার মাধ্যমে সমাজের সংস্কার সাধন।

১৮৯২-এর ৯ ডিসেম্বর তারিখে বানার্ড শ’র প্রথম নাটক ‘উইডোয়ারস হাউসেস’ (Widowers Houses) অভিনীত হল ইবসেনের বিখ্যাত রচনা ‘The Doll’s House’ মঞ্চস্থ হওয়ার তিন বছর পরে। লণ্ডনের ইনডিপেণ্ডেন্ট থিয়েটারে মঞ্চস্থ এই নাটক লণ্ডনের বস্তিবাসীদের দুর্দশা ও বস্তি-মালিকদের হাতে তাদের নিষ্ঠুর পীড়নের কদর্যতাকে উদঘাটিত করেছিল। প্রত্যক্ষ ও সমকালীন সামাজিক সমস্যার এমন বাস্তবনিষ্ঠ চিত্র কখনও ইতিপূর্বে থিয়েটারে দেখা যায়নি।

১৮৯০-এর দশক ছিল কলাকৈবল্যবাদীদের শিল্প-সাহিত্য চর্চার দশক। একই সময়ে নাট্যরচনায় হাত দিয়েছিলেন বানার্ড শ’ কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকতা তাঁর নাটকের প্রধান লক্ষণ। তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল যে, সাহিত্য সামাজিক শিক্ষার জন্য, জীবনের জন্য। নাট্যশিল্পকে তিনি নিয়োজিত করেছিলেন বিচার-বিশ্লেষণ-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে নতুন সমাজ ভাবনা জাগ্রত করবার জন্য।

‘আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান’ (Arms and the Man-1894) তাঁর অন্যতম সেরা নাটক। রোমান্টিক প্রেম ও প্রথাসর্বস্ব বীরপূজার অন্তঃসারশূন্যতাকে, অভিজাতদের ভণ্ডামি ও অহঙ্কারকে এই নাটকে শ’ উন্মোচিত করেছেন অসাধারণ শ্লেষের তির্যকতায় উজ্জ্বল ও ক্ষুরধার সংলাপের মধ্যে দিয়ে। এই নাটকের মুখ্য আকর্ষণ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসে ব্লান্টশ্লি মধ্যরাতে তার প্রাণ বাঁচাতে এসে ঢুকে পড়ে জনৈকা রায়নার ঘরে। রায়না এক রাোমান্টিক কল্পলোকবাসিনী; সে বীর, সার্জিয়াসের বাগদত্তা। ব্লান্টশ্লি অসম্ভব মেধা ও বাকপটুত্বের অধিকারী এক বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন সৈনিক যে সার্জিয়াসকে বর্ণনা করে ডন কুইটের মতো নির্বোধ ও উন্মাদরূপে। অসাধারণ বাকনৈপুণ্য ব্লান্টশি ক্রমে রায়নার মোহভঙ্গ ঘটায়; প্রকৃত বীরত্ব ও সাহস এবং যথার্থ প্রেমের তাৎপর্য বুঝতে পারে রায়না। নাটকের শেষে রায়না স্বামীত্বে বরণ করে ব্লান্টশ্লিকেই। অন্যদিকে সার্জিয়াস আকৃষ্ট হয় পরিচারিকা লুকার প্রতি। ব্যঙ্গ ও সংলাপের চমৎকারিত্ব ‘আর্মস অ্যাণ্ড দ্য ম্যান’ সার্থক রোমান্টিকতা বিরোধী এক কমেডি নাটক যা অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল।

‘কাণ্ডিডা’ (Candida-1895) বার্নার্ড শ’-র পরবর্তী প্রিয় নাটক। জনৈক সমাজতন্ত্রী যাজক মোরেল, মোরেল পত্মী সরলমনা ক্যাণ্ডিডা এবং মোরেলের গৃহে আশ্রয়প্রাপ্ত এক তরুণকে নিয়ে এক ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনী গড়ে তুলেছেন শ’।

‘দি ম্যান অব ডেস্টিনি’ (The Man of Destiny-1895) নাটকের চরিত্র চিত্রণে দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। এই শ্রেণীর আরেকটা নাটক হল ‘ইউ নেভার ক্যান টেল’ (You Never Can Tell-1897) এইসব নাটকে সামাজিক বিষয় স্থান পেয়েছে।

রয়েল কোর্ট থিয়েটারে ১৯০৫-এর ২৩ মে অভিনীত হয়েছিল শ’-র অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকীর্তি ‘ম্যান অ্যাণ্ড সুপারম্যান’। এই নাটকেই বানার্ডশ’ উপস্থিত করলেন তার জীবনীশক্তি তথা ‘Life force’-এর তত্ত্ব, যে শক্তি মানুষকে ক্রমবিবর্তনের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাবে এমন নাটকে তিনি আরেকটি তত্ত্বকে রূপ দিয়েছেন তা হল দারিদ্র্য অসম্মানজনক ও সবরকম। সামাজিক পাশের জন্ম দেয়। সে কারণেই তিনি সমাজ থেকে দারিদ্রের অবলুপ্তি চেয়েছিলেন।

এরপর ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিখ্যাত রোমান্টিক কমেডি ‘পিগম্যালিয়ন’ অভিনীত হয়। জনৈক অধ্যাপকের কাছে শিক্ষা পেয়ে গ্রামের এক ফুলওয়ালী এলিজা কিভাবে তার নারীসত্তার সৌন্দর্য তথা মানবিক সংবেদনশীলতাকে গড়ে তুলল তারই এক অনবদ্য সরল নাট্যরূপ এই নাটকটি।

‘জোয়ান অব আর্ক’ প্রতিবাদী চরিত্র অবলম্বনে লেখা, বার্ণার্ড শ’র সর্বাধিক শিল্পসম্মত নাটসৃষ্টি ভাষ্যকার মহলে স্বীকৃত। এই নাটকে জোনের স্বাধীনচিত্ততা ও তার ভাব-ভাবনা চিরন্তন রূপ পেয়েছে।

বানার্ড শ’র শেষ গুরুত্বপূর্ণ নাটক ‘দ্য অ্যাপল কার্ট’ একটি পরিণত ও সরস রচনা। এর প্রারম্ভিক সংলাপ অংশের সরস ঔজ্জ্বল্য এবং রাজা ম্যাগনাসের চরিত্র উল্লেখযোগ্য।

সুতরাং বার্নার্ড শ তার নাটকে ফেবীয় সমাজতন্ত্রী সামাজিক প্রথা ও পীড়নের সমালোচনা করেছেন। তিনি নির্বিচারে আক্রমণ করেছেন বিচার ব্যবস্থা, যুদ্ধ, প্রেম, বিবাহ, ইত্যাদি বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানসমূহকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলিকে বলিষ্ঠ ভাবে উদ্‌ঘাটন করেছেন তাঁর নাটকে।

বার্নার্ড শ’র নাট্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য

প্রথাবিরোধিতা: ক্ষুরধার ব্যঙ্গ, উজ্জ্বল ও শাণিত সংলাপ এবং এক অনবদ্য লঘু চপল ভঙ্গী নিয়ে শ’ চমকৃত করেছিলেন তরল ও আবেগসর্বস্ব সামাজিক নাটকের প্রথাসর্বস্বতায় অভ্যস্ত দর্শকমণ্ডলীকে। তাঁর নাটকগুলি ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও দার্শনিক মতামত বা ভাবধারার মাধ্যমে চরিত্র ও ঘটনাসমূহ অধিকাংশ রচনাতেই নাট্যকারের ধ্যান ধারণার বাহন হয়ে উঠেছিল। তিনি Creative Evolution-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা।

ভূমিকা ব্যবহার: শ’র প্রায় প্রতিটি নাটকেই রয়েছে দীর্ঘ ‘ভূমিকা’ (Preface)যাতে নাট্যকার জোরালো ভাবে তার চিন্তা ভাবনাগুলিকে বিবৃত করেছেন। এই দীর্ঘ ভূমিকার মাধ্যমে হাস্য পরিহাস ও তীব্র ভাষণের দ্বারা শ’ তাঁর বক্তব্যকে পরিস্ফুট করেছেন।

চরিত্রচিত্রণে বৈচিত্র্য: চরিত্র চিত্রণে বানার্ডশ’ যে বৈচিত্র্য ও বাস্তবনিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন তা একমাত্র শেল্পীয়ারের নাট্য চরিত্রগুলির সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। চরিত্রগুলি তার উদ্দেশ্যের বাহন হয়ে উঠেছে।

ব্যঙ্গপ্রবণতা: বুদ্ধিদীপ্ত সরসতা (Wit) শ’-র কমেডি নাটকগুলোর প্রাণ। মননশীল নাট্যকার ও সমাজচিন্তার অক্লান্ত অগ্রদূত বানার্ডশ’ ব্যঙ্গ পরিহাসকে একটি অত্যন্ত কার্যকর ও বুদ্ধিদীপ্ত অস্ত্রে পরিণত করেছিলেন। তির্যক ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ও কোমল হাস্যরস উভয়েই শ’-র নাটকের উপভোগ্যতা বৃদ্ধির পক্ষে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল, কিন্তু আবেগের মাধুর্য বা গভীরতা তার নাটকে তেমন পাওয়া যায় না।

প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা: নাটককে শ’ সামাজিক অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহের সমালোচনা ও বিশ্লেষণের হাতিয়ার রূপে দেখেছিলেন। আর এই হাতিয়ার ব্যবহারের পেছনে কাজ করেছিল তার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। তিনি সমাজকে দলে ফেলে সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন।

বানার্ড শ’ শিল্পের জন্য শিল্প এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর মতে শিল্প জীবনের জন্য। তাঁর বিদ্রোহ প্রচলিত সমাজ প্রেম, ধর্ম ও আদর্শের বিরুদ্ধে।

প্রাকরণিক অভিনবত্ব: প্রাকরণিক অভিনবত্বে শ’-র দক্ষতা ছিল উচ্চাঙ্গের এবং তার নাটকে সংলাপ নির্মাণ এক অভাবনীয় সাফল্যের পর্যায়ে পৌছেছিল। যেমন, ছোট ছোট চোখা বাগ বিনিময়ে, তেমনি দীর্ঘ আলোচনায় শ’ এক স্বতন্ত্র মাত্রা যোগ করেছিলেন তাঁর নাটকগুলিতে। এছাড়াও তার নাটকগুলিতে সূক্ষ্ম মঞ্চনির্দেশ (stage direction) দিয়েছেন ইবসেনের অনুসরণে। আবার ক্লাসিক কাব্যকলার ত্রি-ঐক্য বিধি তিনি ত্যাগ করেছেন।

নাট্যপ্রকরণ বা কৌশল: তাঁর নাটক প্রচারধর্মী ও ধারণা প্রধান হওয়া সত্ত্বেও বাণিজ্যে নাট্যশিল্পের টেকনিকগত দিকণ্ডলি উপেক্ষা করেছিলেন এমন নয়। উদাহরণ স্বরূপ ম্যান অ্যাণ্ড সুপারম্যান’ ও ‘সেন্ট জোন’ নাটকের ‘Epilogue’ অংশ এবং ‘ব্যাক টু মেথুসেলা’র বিশালায়তন গঠন বিন্যাসের উল্লেখ করা চলে।

বার্ণার্ড শ’ ও বাংলা নাটক

বাংলা সাহিত্যে বার্ণার্ড শ’এর প্রভাব যথেষ্ট। তার কলাকৈবল্যবাদ (Art for art’s sake) বাংলা সাহিত্যিকদের প্রভাবিত করেছিল। নাটক বা সাহিত্যের নান্দনিক মূল্য নিশ্চয় থাকবে, কিন্তু চলমান জীবন ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও শিল্পীর থাকা বাঞ্ছনীয়। শ’র এইমতবাদ বাংলায় আধুনিক যুগের নাট্যকারদের প্রভাবিত করেছে। দীনবন্ধু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, তুলসী লাহিড়া প্রভৃতি নাট্যকারদের কথা এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। নীলদর্পণ’, নবান্ন’, ‘ছেঁড়াতার’ তার প্রমাণ।

রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘বড় আমি’ ‘ছোট আমি’ বলেছেন কিংবা সাজাহান কবিতায় আমি ও ‘সে’-র কথা বলেছেন তার সঙ্গে বার্ণার্ড শ’-এর ম্যান অ্যাণ্ড সুপার ম্যান’, নাটকের সাদৃশ্য রয়েছে।

তথ্যসূত্র:

ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসDownload
ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস – শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়Download
ইংরেজি সাহিত্য পরিচয় – অরবিন্দ পোদ্দারDownload
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস – কুন্তল চট্টোপাধ্যায়Download
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ও মূল্যায়ন – বিমলকৃষ্ণ সরকারDownload
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস – অরুণ ভট্টাচার্যDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!