//
//

বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের বিকাশে বুদ্ধদেব বসুর অবদান আলোচনা কর।

বুদ্ধদেব বসু

(১৯০৮-১৯৭৪)

কল্লোল ও প্রগতি পত্রিকার অন্যতম লেখক সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) রবীন্দ্রোত্তর যুগের উল্লেখযোগ্য কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তাঁ প্রবন্ধগুলি মূলত সাহিত্যবিষয়ক। একজন কবি যখন প্রাবন্ধিক বা সমালোচকহন তখন তা স্বাভাবিকভাবেই হয়ে ওঠে শিল্প। কবি বুদ্ধদেব বসুর কলমে যে সমালোচনা, তা যেমন মার্জিত তেমনি তাঁর গদ্যের শিল্পরূপ শোভন ও সুন্দর, বলাবাহুল্য তা মৌলিকতায় ভাস্বর। প্রবন্ধশিল্পী হিসেবে তাঁর মৌলিকতার কারণ হল—সাহিত্যিক বিষয়, বিশিষ্ট রচনা রীতি, স্বতন্ত্র বাগভঙ্গি এবং উপমাবহুল সুললিত ভাষা। বলাবাহুল্য তাঁর বেশিরভাগ প্রবন্ধই ব্যক্তিগত প্রবন্ধের গোত্রভুক্ত।

তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থগুলি হল— ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’ (১৯৩৫), ‘সমুদ্রতীর’ (১৯৩৫) ‘আমি চঞ্চল হে’ (১৯৩৭), ‘সব পেয়েছির দেশে’ (১৯৪১), ‘উত্তর তিরিশ’ (১৯৪৫), ‘কালের পুতুল’ (১৯৪৬), ‘সাহিত্যচর্চা’ (১৯৫৪), ‘রবীন্দ্রনাথ ও কথাসাহিত্য’ (১৯৯৫) ‘স্বদেশ ও সংস্কৃতি’ (১৯৫৭), ‘জাপানি জার্নাল’ (১৯৬২), ‘সঙ্গ: নিঃসঙ্গতা রবীন্দ্রনাথ’ (১৯৬৩), ‘দেশান্তর’ (১৯৬৬), ‘কবি রবীন্দ্রনাথ’ (১৯৬৬), ‘আমার ছেলেবেলা’ (১৯৭৩), ‘মহাভারতের কথা’ (১৯৭৪), ‘কবিতার শত্রু ও মিত্র’ (১৯৭৪), ‘আমার যৌবন’ (১৯৭৬-মৃত্যুর পরে প্রকাশিত)। এছাড়া ‘An Acre of Green Grass’ ও ‘Tagore portrait of a poet’ নামে দুটি ইংরেজি প্রবন্ধ গ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন।

প্রবন্ধ ও সমালোচনা সাহিত্যের যে ধারা বঙ্কিমচন্দ্র সূত্রপাত করেছিলেন তা রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে যৌবনে বিকশিত হয়েছিল। বুদ্ধদেব বসু সেই ধারাকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেন। বিশেষ করে সাহিত্য সমালোচনার যে ধারা তিনি বাংলা সাহিত্যে নিয়ে এসেছিলেন তার দ্বারা বাংলা গদ্যসাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছিল। কেননা প্রাবন্ধিকের অতন্দ্র শিল্পীসত্তা, সংস্কারমুক্ত মন, মানবতাবোধে উদ্দীপ্ত এক আধুনিক মানসিকতা এবং শিল্পীসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্যকে দিয়েছে স্বতন্ত্র মর্যাদা।

বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধ ও সমালোচনার বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম বিষয় হল— রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্য। যেমন, ‘রবীন্দ্রনাথ ও কথাসাহিত্য’, ‘সঙ্গ: নিঃসঙ্গতা রবীন্দ্রনাথ’, ‘কবি রবীন্দ্রনাথ’, ‘সাহিত্যচর্চা’ প্রভৃতি। রবীন্দ্র-অনুরাগী হয়েও তিনি রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা যেমন করেছেন, তেমনি রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার মূল্যায়ন করে পরবর্তীকালে তাঁর প্রভাবেরও পরিমাপ করেছেন। যেমন, ‘সাহিত্যচর্চা’ প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্যের যে মূল্যায়ন করেছেন, তা প্রশংসার দাবী রাখে। ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে তিনি যে ঐতিহাসিক ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় রেখেছেন, তাতে প্রাবন্ধিক ও সমালোচক হিসেবে তিনি স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। যেমন, আলোচ্য প্রবন্ধটিকে চারটি পর্যায়ে বিন্যস্ত করেছেন। প্রথম পর্যায়ে রয়েছ স্বভাবকবির প্রসঙ্গ এবং বাংলা কাব্যসাহিত্যে বিশ শতকের প্রথম দু’দশকের সংকট। দ্বিতীয় পর্যায়ে সত্যেন্দ্রনাথ ও সমকালীন কবিদের মূল্যায়ন; তৃতীয় পর্যায়ে কল্লোল গোষ্ঠীর নতুনতর প্রচেষ্টা ও বাংলা সাহিত্যে মোড় ফেরাবার ঘণ্টাধ্বনি এবং চতুর্থ পর্যায়ে রয়েছে দুই মহাযুদ্ধ মধ্যবর্তী কবিদের মূল্যায়ন ও রবীন্দ্রনাথের

‘সঙ্গ: নিঃসঙ্গতা রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধ গ্রন্থের দুটি পর্যায়। প্রথমটিতে সঙ্গ ও নিঃসঙ্গতাকেন্দ্রিক আলোচনায় আধুনিক কবিদের বৈশিষ্ট্য এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, রাজশেখর বসু প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ শীর্ষক অংশে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ, উপমা, রবীন্দ্রনাথ ও প্রতীক সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

‘স্বদেশ ও সংস্কৃতি’ প্রবন্ধ গ্রন্থটি বিভিন্ন ধরনের প্রবন্ধের সংকলন। এগুলি বিশুদ্ধ প্রবন্ধ। বুদ্ধদেব বসু যে সমাজসচেতন ছিলেন, সমকালীন রাজনীতি ও সমাজ যে তাকে বিচলিত করতো তার প্রমাণ এই প্রবন্ধ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলি।

‘কালের পুতুল’ গ্রন্থটিও সমালোচনামূলক প্রবন্ধ গ্রন্থ। এগুলি ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর ‘মহাভারতের কথা’ প্রবন্ধ গ্রন্থটি আসলে মহাভারতের কোনো কোনো দিকের নবমূল্যায়ন। মহাভারতের প্রাণকেন্দ্র, এর মূল শিক্ষা, মহাভারতের নায়ক প্রভৃতির উত্তর খুঁজেছেন প্রাবন্ধিক। এই গ্রন্থে প্রাবন্ধিকের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিকতা প্রশংসনীয়।

বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিচারণামূলক প্রবন্ধগুলি রসরচনার পর্যায়ে পড়ে। তিনি এগুলিতে যেন রূপকথার জগৎ নির্মাণ করেছেন, পাঠককে নিয়ে গেছেন এক অচেনা জগতে। ‘সমুদ্রতীর’, ‘আমি চঞ্চল হে’, ‘সব পেয়েছির দেশে’ এই ধরনের প্রবন্ধগ্রন্থ। এ যেন প্রাবন্ধিকের স্বপ্নমায়ার দেশ, যা তিনি নিজস্ব ক্ষমতায় গড়ে তুলেছেন। এর ভাব ও ভাভাষার রমণীয়তা এক স্বপ্ন কল্পনার জগতে নিয়ে যায় বলেই তা রম্যরচনার গোত্রভুক্ত করা যেতে পারে।

বুদ্ধদেব বসু ভ্রমণ কথাও লিখেছেন। যেমন, ‘আমার ছেলেবেলা’, ‘আমার যৌবন’ প্রভৃতি। আবার ‘ছোটদের রামায়ণ’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে এক আশ্চর্য সুখকর অভিজ্ঞতা।

প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসুর কৃতিত্ব

  • যে শিল্পবোধ থাকলে ব্যক্তিগত প্রবন্ধ উৎকর্ষ লাভ করে সেই বোধ বুদ্ধদেব বসুর ছিল, তাঁর অন্তরঙ্গ শিল্পীস্বভাব একদিকে এবং অন্যদিকে যুক্তি-পরম্পরা তাঁর প্রবন্ধগুলিকে নিখুঁত শিল্পের পর্যায়ে উত্তীর্ণ করে দিয়েছে।
  • সাহিত্যের আলোচনায়, বিশেষ করে দেশী ও বিদেশী সাহিত্যের বিভিন্ন দিকের বিশ্লেষণে তাঁর রুচিবোধের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে মার্জিত সাহিত্যিক প্রবন্ধ রচনার পথিকৃৎ হয়ে থাকবেন তিনি।
  • প্রাবন্ধিক হিসেবে তিনি ম্যাথু আর্নল্ডের প্রবন্ধের ভারসাম্য, যাথার্থ্য, শৃঙ্খলকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে।
  • তাঁর প্রবন্ধগুলি তথ্য ও যুক্তির আলোকে এবং বিশ্লেষণের নৈপুণ্যে হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে।
  • সুকুমার সেন প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসুর গদ্য রচনার রীতি সম্পর্কে লিখেছেন— “বুদ্ধদেব বাবুর গদ্যরীতি সত্নরচিত, সুমিত, পরিপাটি।”
  • তাঁর প্রবন্ধগুলিতে আত্মবিশ্বাসজাত এক নিজস্ব পরিমণ্ডল লক্ষ করা যায় যার মধ্যে রয়েছে কবিহৃদয়ের মগ্নতা। এই মগ্নতা পাঠককে আকর্ষণ করে, মোহিত করে।
  • সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসু যে বিজ্ঞতা, পরিশীলিত রুচি, উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় রেখেছেন তাতে সমালোচনার একটি বিশেষ ধারা বাংলা সমালোচনা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
  • ইংরেজি সাহিত্যের সমালোচনার ক্ষেত্রে বোদলেয়ার, রিলকে সম্বন্ধে তার আলোচনা এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গে দান্তে, মালার্মে, এলিয়ট, পাউণ্ড সম্পর্কিত আলোচনা তাঁর পাণ্ডিত্য ও বিদেশী সাহিত্য চর্চার ফসল।
  • তাঁর প্রবন্ধশৈলী ইমপ্রেশনিষ্টিক। তাই তা পাঠকের শিল্পবোধ ও নান্দনিক চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করে।
  • গদ্যের প্রাণবন্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত রূপ তাঁর গদ্যরীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেমন, ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতির সঙ্গে সত্যেন্দ্র গোষ্ঠীর পার্থক্য ও স্বাতন্ত্র্য বোঝাতে গিয়ে লিখেছেন— “সত্যেন্দ্র গোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথের প্রতিধ্বনি করতেন নিজেরা তা না জেনে—সেইটেই মারাত্মক হয়েছিলো তাদের পক্ষে; আর এই কবিরা সম্পূর্ণরূপে জানেন রবীন্দ্রনাথের কাছে কত ঋণী এঁরা, আর সে কথা পাঠককে দিতেও সংকোচ করেন না, কখনো কখনো আস্ত আস্ত লাইন তুলে দেন আপন পরিকল্পনার সঙ্গে মিলিয়ে। এই নিষ্কুণ্ঠতা, এই জোরালো সাহস—এটাই এঁদের আত্মবিশ্বাসের স্বাবলম্বিতার কারণ।”
  • বুদ্ধদেব বসুর গদ্য তথ্য, তত্ত্ব ও যুক্তির বিন্যাসে হয়ে উঠেছে কবিত্বময় এবং পরিশীলিত। যেমন, সত্যেন্দ্রনাথ গোষ্ঠীর প্রতিভার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে লিখেছেন— “রবীন্দ্রনাথের কবিতা প্রথমে সত্যেন্দ্রনাথের, তারপর তাঁর শিষ্যদের হাতে সাত দফা পরিস্রুত হতে হতে শেষ পর্যন্ত যখন ঝুমঝুমি কিংবা লজেঞ্চুসের মও পদ্য রচনায় পতিত হলো, তখনই বোঝা গেল যে ওদিকে আর পথ নেই—এবার ফিরতে হবে।”
  • প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু সুরসিক ছিলেন বলেই সমালোচনার ক্ষেত্রে তাঁর সহাস্য স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয়েছে। যেমন, নিজের কথা নিজের মতো করে বলার ইচ্ছা ছিল বলেই রবীন্দ্রনাথকে কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকরা দূরে সরিয়ে রাখলেন। এই প্রসঙ্গে সমালোচকের উক্তি— “ফজলি আম ফুরোলে ফজলিতর আম চাইবো না, আতাফলের ফরমাস দেবো ‘শেষের কবিতা’র এই ঠাট্টাকেই এখনকার পক্ষে সত্য বলে ধরা যায়।”

সুতরাং প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসুর গদ্যের গায়ে লেগে আছে কবিতার সৌরভ, সেই সৌরভে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতায়, বাগবিন্যাসের বলিষ্ঠতায়, দৃষ্টিভঙ্গির উদারতায়, সাবলীল প্রকাশ ভঙ্গিমায় তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্য মৌলিকতায় ভাস্বর। পাঠকও সেই অলৌকিক মায়ার জগতে প্রবেশ করে রসাস্বাদনজনিত আনন্দলাভে তৃপ্ত হয়। এখানেই কবি প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসুর অনন্যতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!