বৈদিক সাহিত্যের বিভিন্ন ভাগগুলির সাধারণ পরিচয় দাও।
বৈদিক সাহিত্য
বেদ
শাস্ত্রই আর্য-হিন্দুদের আত্মপরিচয়। বেদ, বেদান্ত, উপনিষৎ, দর্শন, পুরাণেই তাদের আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি, ধর্ম-কর্ম সবকিছুর নিদর্শন রয়েছে। শাস্ত্রই হিন্দুর পুরাতত্ত্ব, শাস্ত্রই তাদের ইতিহাস, শাস্ত্রই তাদের চরিত্র-চিত্র। এই শাস্ত্রের আদি নিদর্শন—বেদ। ব্রহ্ম মুখনিঃসৃত ধর্মার্থজ্ঞাপক শাস্ত্র—বেদ। বেদই শাস্ত্রের চূড়ামণি। শব্দগর্ত দাত্বর্থেও বেদের তাই অর্থ প্রতিপন্ন হয়। বেদ—‘বিদ্’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন; ’বিদ্’ ধাতুর অর্থ—ধর্মাধর্ম জানা; অর্থাৎ যার দ্বারা ধর্মাধর্ম সকল বিষয়ের অভিজ্ঞতা লাভ হয়, তাই ‘বেদ’।
বাকি সমস্ত শাস্ত্র, সবই বেদ থেকে উৎপন্ন; বেদ— কাণ্ড, অন্যান্য শাস্ত্র তার শাখা-প্রশাখা বিশেষ। ঋক, যজু, সাম—বেদের তিনটি অঙ্গ; সেইজন্যই বেদের অপর নাম—ত্রয়ী। যজ্ঞকর্মের সুবিধার জন্য বেদকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছিল। সেইসময় থেকেই ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদের সৃষ্টি। প্রথম তিনটি বেদেই যজ্ঞকর্মের যাবতীয় বিধির সমাবেশ ঘটেছে, সে-কারণে এই তিনটি বেদই পরবর্তীকালে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
বেদের বিভাগ সম্বন্ধে দুটি মতের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রথমত, মহর্ষি বেদব্যাস, যুগে যুগে ধর্মের পাদক্ষয় এবং মানুষের আয়ুশক্তির হ্রাস দেখে বেদের বিভাগ করেছিলেন, বেদবিভাগ-কর্তা বলেই তাঁর নাম—বেদব্যাস। বিষ্ণুপুরাণের তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে এবং শ্রীমদ্ভাগবৎ-এর দ্বাদশ স্কন্ধ ষষ্ঠ অধ্যায়ে বলা আছে—বেদব্যাস বেদবিভাগ করে পৈলকে ঋগ্বেদ-সংহিতা, বৈশম্পায়নকে যজুর্বেদ-সংহিতা, জৈমিনিকে সামবেদ-সংহিতা এবং সুন্তুকে সামবেদ-সংহিতা দান করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, যজ্ঞকর্মের সুবিধার জন্য অথর্ব ঋষি বেদ-বিভাগ করেছিলেন।
তিনি যজ্ঞকর্মের উপযোগী সূক্তগুলিকে প্রথম তিনটি বেদের অন্তর্ভুক্ত করে, অন্যান্য সূক্তগুলিকে আলাদা করেন। যারা প্রথম মতের সমর্থক, তারা মনে করেন—যজ্ঞকর্মের অনুপযোগী বা অকর্মণ্য অর্থ বোঝানোর জন্য ঋক, যজু, সাম—এই বেদের অতিরিক্ত সূক্তগুলিকে অথর্ববেদ নামে অভিহিত করা হয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় মতের সমর্থনকারীদের মতে—অর্থবঋষির নামানুসারে শেষোক্ত বেদ অথর্ববেদ নামে পরিচিত হয়েছে। দুই মতকে সামনে রেখে বলা যায়—প্রথমে এব বেদ ঋক-যজু-সাম তিন অঙ্গে প্রকটমান ছিল। ক্রমশ তারা চারটি স্বতন্ত্র ভাগে বিভক্ত হয়। পরিশেষে তার শাখা-উপশাখারূপে অন্যান্য শাস্ত্রাদির অভ্যুদয় হয়েছে।
বর্তমান কালে যে প্রণালীতে বেদ-সংহিতা সংগৃহীত হয়েছে, তাতে বেদের রচয়িতা সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবেই মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমেই জানতে হবে বেদ কী, বা বেদে কী আছে। পূর্বের বলা হয়েছে ধর্মাধর্ম বিষয়ে অভিজ্ঞতার সমষ্টি হল বেদ। অর্থাৎ ঈশ্বরের অনুকম্পা লাভ করাই বৈদিক মন্ত্রের উদ্দেশ্য। ঋষি-মহর্ষি-নরদেবতাগণ ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করার জন্য তন্ম হয়ে, আত্মবিসর্জন দিয়ে যে ভাষায়, যে ভাবে, তাঁকে আহ্বান করেছিলেন, বৈদিক মন্ত্রে স্তোত্রাকারে তাই গ্রথিত হয়েছে। প্রথম কোন কণ্ঠের কোন সুধাস্বরে সে ধ্বনি নির্গত হয়েছিল, তা কেউ বলতে পারে না। যে ব্রাহ্মণ সন্তান তিনসন্ধ্যা গায়ত্রী মন্ত্র জপ করেন; পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ বা অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহের কাছ থেকে সে মন্ত্র পেয়ে থাকতে পারেন।
এভাবেই বেদ বংশপরম্পরায় প্রচলিত। তবে বেদের এক এক মণ্ডলে বা এক এক ভাগে ভিন্ন ভিন্ন ঋষির নাম দেখতে পাই, তার কারণ অন্য। এক এক সংসারে এক এক প্রকারের মন্ত্র প্রচলিত থাকা অসম্ভব কিছু ছিল না সেইসময়ে। সেই সংসারের কর্তা আপন বংশ-পরম্পরার ব্যবহারের জন্য সেইসকল মন্ত্র যদি সংগ্রহ বা লিপিবদ্ধ করে যান, তাহলে তাঁকে কখনই সেই মন্ত্রের রচয়িতা বলা যায়। পুরুষ-পরম্পরায় যে যে মন্ত্র চলে আসছিল, এক এক ঋষি সেইসমস্ত মন্ত্র সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। ফলে যাঁদের নামে বৈদিক মন্ত্র প্রচলিত তাঁরা সেই মন্ত্রের সংগ্রহকর্তা, রচয়িতা নন। একারণেই বলা হয়—বেদ অনাদি, বেদ অপৌরুষের, বেদ ব্রহ্মামুখনিঃসৃত বাণী।
বেদ—অনাদি। বেদ—অনন্তকাল থেকে মানব-সংসারে বিরাজমান। বেদের উৎপত্তি সম্পর্কে একাধিক মতের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথমত, প্রজাপতি ব্রহ্মার চতুর্মুখ থেকে বেদ-চতুষ্টয়ের উৎপত্তি হয়েছে। (বিষ্ণুপুরাণ ও অন্যান্য পুরাণ) দ্বিতীয়ত, মনু ঋষির মতে—স্বয়ং ঈশ্বর যজ্ঞকার্যের জন্য অগ্নি থেকে ঋগ্বেদ, বায়ু থেকে যজুর্বেদ, এবং সূর্য থেকে সামবেদ দোহন করেছিলেন। এই বেদত্রয় সনাতন। (মনুসংহিতা, প্রথম অদ্যায়, ২৩শ শ্লোক)। এইসমস্ত শাস্ত্রকে প্রাধান্য দিলে বেদের রচনাকাল নিরূপণ করা বিড়ম্বনা মাত্র।
বেদ-চতুষ্টয়ের মধ্যে ঋগ্বেদই আদিগ্রন্থ। এটি দশটি মণ্ডলে বিভক্ত। প্রথম মণ্ডলের রচয়িতা হিসেবে একাধিক ঋষির নাম পাওয়া যায়। এই মণ্ডলে ২৪ টি অনুবাক এবং ১৯১ টি সূক্ত রয়েছে। দ্বিতীয় মণ্ডলের রচয়িতা—গৃৎসমদ্। এই মণ্ডলে ৪ টি অনুবাক এবং ৪৩ টি সূক্ত আছে। তৃতীয় মণ্ডলের রচয়িতা—বিশ্বামিত্র। এই মণ্ডলে ৫ টি অনুবাক এবং ৬২ টি সূক্ত আছে। চতুর্থ মণ্ডলের রচয়িতা—বামদেব। এই মণ্ডলে ৫ টি অনুবাক এবং ৫৮ টি সূক্ত আছে। পঞ্চম মণ্ডলের রচয়িতা—অত্রি। এই মণ্ডলে ৬ টি অনুবাক এবং ৮৭টি শ্লোক আছে। ষষ্ঠ মণ্ডলের রচয়িতা—ভরদ্বাজ। এই মণ্ডলে ৬ টি অনুবাক এবং ৭৫ টি সূক্ত আছে। সপ্তম মণ্ডলের রচয়িতা—বশিষ্ঠ। এই মণ্ডলে ৬ টি অনুবাক এবং ১০৪ টি সূক্ত রয়েছে।
অষ্টম মণ্ডলের রচয়িতা—কণ্ব। এই মণ্ডলে ১০ টি অনুবাক এবং ১০৩ টি সূক্ত আছে। নবম মণ্ডলের রচয়িতা—অঙ্গিরা। এই মণ্ডলে ৭ টি অনুবাক এবং ১১৪ টি সূক্ত আছে। দশম মণ্ডলের রচয়িতা হিসেবে একাধিক ঋষির নামোল্লেখ আছে। এই মণ্ডলে ১২ টি অনুবাক এবং ১৯১ টি সূক্ত আছে। এর পাশাপাশি শ্লোক সংখ্যা এবং শব্দাংশের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা আছে। শৌনক মুনি রচিত ‘চরণ-ব্যূহ’ গ্রন্থে ঋগ্বেদের আটটি ভেদের কথা বলা হয়েছে—চর্চা, শ্রাবক চর্চক, শ্রবনীয় পার, ক্রমপার, ক্রমজটা, ক্রমরথ, ক্রমশট, ক্রমদণ্ড। ঋগ্বেদের মোট পাঁচটি শাখা—আশ্বলায়িনী, সাঙ্খ্যায়নী, শাকলা, বাস্কলা এবং মাণ্ডুকা। যাগযজ্ঞের নিয়মাবলী এবং ক্রিয়া-প্রণালী বিবৃত করে ঋগ্বেদের দুটি শাখা বিভাজন করা হয়েছে। এই দুটি শাখা দুটি ‘ব্রাহ্মণ’ নামে পরিচিত। একটি ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, প্রণেতা মহিদাস ঐতরেয়। অন্যটি কৌষিতকী বা সাঙ্খ্যায়ন, প্রণয়েতা ঋষি কৌষিতকী।
যজুর্বেদ দুটি অংশে বিভক্ত—কৃষ্ণ যজুর্বেদ এবং শুক্ল যজুর্বেদ। কৃষ্ণ যজুর্বেদের ব্রাহ্মণ ভাগের নাম—তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ। শুক্ল যজুর্বেদের ব্রাহ্মণ ভাগের নাম—শতপথ ব্রাহ্মণ। যজুর্বেদ তিন শাখায় বিভক্ত—তৈত্তরীয়, মাধ্যন্দিন ও কান্ব। সামবেদ সংহিতার দুই ভাগ—উত্তর ও পূর্ব। শাখাও দুটি—কৌথুমী ও রাণ্যায়ন। কৌথুম ঋষি প্রথম সাখার এবং রাণ্যায়ন ঋষি দ্বিতীয় শাখার প্রবর্তক। সামবেদের ব্রাহ্মণ সংখ্যা আট। এছাড়াও ‘অদ্ভুত ব্রাহ্মণ’ নামে সামবেদের একটি ব্রাহ্মণ আছে। অথর্ববেদ প্রধানত নয় ভাগে বিভক্ত। পূর্বে এই বেদের অনেক শাখা ছিল। কিন্তু শৌনক শাখা ছাড়া অন্য কোনো শাখার উল্লেখ পাওয়া যায় না। অথর্ববেদের ব্রাহ্মণ-ভাগের নাম ‘গো-পথ ব্রাহ্মণ’। বর্তমান অথর্ববেদ কুড়িটি খণ্ডে বিভক্ত। চারটি বেদেই প্রায় একরূপ দেবতা এবং ঋষিগণের নাম পাওয়া যায়। বেশিরভাগ অথর্ববেদে যম, মৃত্যু, কাল, দানব প্রভৃতির কতগুলি স্ত্রোত্র আছে।
বেদই হিন্দুর ধর্ম, বেদই হিন্দুর কর্ম, বেদই হিন্দুর হিন্দুত্ব। এককথায় যিনি বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করেন—তিনিই হিন্দু নামে অভিহিত হন। বেদ মেনে চলার অর্থ—বর্ণাশ্রম মানতে হয়, অদৃষ্ট মানতে হয়, মন্ত্রশক্তি মানতে হয়। শাস্ত্রে এমনও দেখা যায়—কেউ বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করেছেন, কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেননি, তিনিও আস্তিক হিন্দুর আসন লাভ করেছেন (মহর্ষি কপিল)। আবার কেউ কেউ বেদ মানেননি, অথচ ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন—তিনি নাস্তিক অহিন্দু নামে অভিহিত হয়েছেন (গৌতম মুনি)।
যারা হিন্দুর মধ্যেবিশ্বজনীন ভাবের অভাব দেখেন, বেদ তাঁদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারে। যাঁরা বলেন ‘বেদ কৃষকের গান’; বেদে কৃষিকার্যের উন্নতির জন্য উপাসনা আছে—বৈদিক ঋষিগণ কৃষি-কার্যের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন, সুতরাং ঋষিরা কৃষক ছিলেন। তাঁদের ন্যায় ভ্রান্তবুদ্ধির ব্যক্তিকেও বেদ দেখাতে পারেন—কৃষির উন্নতির জন্য ভগবানের করুণা-প্রার্থনা উদার বিশ্বজনীন ভাবেরই অতিব্যক্তি মাত্র। কৃষির উন্নতি হলে বসুন্ধরা শস্য-সম্পদে পরিপূর্ণ হলে, জনসাধারণের সকলেরই সুখ-সৌভাগ্যে দেশ সমুন্নত শ্রীবৃদ্ধিসম্পন্ন হতে পারে—আর্যহিন্দুরা একারণেই মনে-প্রাণে কৃষির উন্নতির জন্য প্রার্থনা করেছেন (ঋগ্বেদের চতুর্থ এবং দশম মণ্ডল)। এই ঘটনা তাঁদের স্বদেশ-বাৎসল্য ও স্বজাতি-হিতৈষণারই পরিচায়ক। কারণ কৃষির উন্নতির জন্য প্রার্থনা করলেই তাঁকে কৃষক বলা যায় না।
জাতিভেদ প্রথা বিষয়ে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে মীমাংসা আছে। পুরুষ যখন বিভক্ত হন, তখন তিনি চারভাগে বিভক্ত হয়েছিলেন। তার মুখে ব্রাহ্মণ, বাহুযুগলে রাজন্য, উরুতে বৈশ্য এবং পদযুগলে শুদ্র উৎপন্ন হয়েছিল। এই চারটি বর্ণ পরবর্তীকালে বিভিন্ন সাখা-উপশাখায় বিভক্ত হয়ে সমাজকে পরিপুষ্ট করে চলেছে। আগে জন্ম, পরে কর্ম—এটাই হিন্দু শাস্ত্রের মূল বক্তব্য। যদিও আধুনিক কালে এই মতকে মান্যতা দেওয়া হয় না।
ব্রাহ্মণ
‘ব্রহ্মণ্’ শব্দের একটি অর্থ ‘বেদ’ বা ‘বেদমন্ত্র’। ব্রাহ্মণ হল বেদের দ্বিতীয় অংশ। মূলত বৈদিক ক্রিয়াকর্ম ও যাগযজ্ঞের নির্দেশে পূর্ণ। ব্রাহ্মণ হল বেদের কর্মকাণ্ড। এজন্য বআহ্মণকে বৈদিক যুগের পুরোহিত দর্পণ বলা হয়। বিভিন্ন বেদের ব্রাহ্মণ বিভাগ ভিন্ন। ঋগ্বেদের দুটি ব্রাহ্মণ—ঐতরেয় ও কৌষীতকি। সামবেদের তিনটি ব্রাহ্মণ—পঞ্চবিংশ বা তাণ্ড্য মহাব্রাহ্মণ, ষড়বিংশ ও জৈমিনীয়। যজুর্বেদের তিনটি ব্রাহ্মণ—কৃষ্ণ যজুর্বেদের দুটি (কঠ ও তৈত্তিরীয়) এবং শুল্ক যজুর্বেদের একটি ব্রাহ্মণ—শতপথ।
অন্যদিকে অথর্ববেদের ব্রাহ্মণের নাম গোপথ। ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলির মধ্যে ঐতরেয় ব্রাহ্মণ হল সবচেয়ে প্রাচীন। এতে ঋগ্বেদীয় মন্ত্রগুলির প্রয়োগবিধি ও ব্যাখ্যা আছে। এই ব্রাহ্মণের তেত্রিশ নং অধ্যায়ে রয়েছে দেবরাত শুনঃশেপের কাহিনি। আবার শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণের মধ্যে রয়েছে প্রাচীন পুরাণ ও ইতিহাসের বহু তথ্য। মৎসপুরাণের বহুখ্যাত মনু-মৎস্য কাহিনি এর অন্তর্গত। সাম সংহিতার তাণ্ড্য ব্রাহ্মণে ব্রাত্যবোষ্টমের বিধান গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্রাত্যষ্টোম আসলে অনার্য জাতিকে শুদ্ধ করে আর্যসমাজে গ্রহণ করার প্রতীক। অথর্ববেদের গোপথ ব্রাহ্মণে দেখা যায়, বেদের সারভূত হল অথর্ববেদ। এই ব্রাহ্মণকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে ভারতীয় দর্শন-কর্ম-মীমাংসা দর্শন।
ব্রাহ্মণ সাহিত্য যজ্ঞানুষ্ঠানের অলৌকিক মহিমাকে তুলে ধরেছে। যজ্ঞানুষ্ঠান যে কালক্রমে মানবজীবনের মুখ্য লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা ব্রাহ্মণ থেকেই উপলব্ধি করা যায়। ব্রাহ্মণের সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ হল তায় গল্পাংশ। যেমন পুরূরবা-ঊর্বশীর কাহিনি শতপথ ব্রাহ্মণের অন্তর্গত। জীবনবোধের দিক থেকেও ব্রাহ্মণ গ্রন্থ তাৎপর্যপূর্ণ। ‘চরৈবেতি’ মন্ত্র ঐতরেয় ব্রাহ্মণের। গদ্য সাহিত্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আর এইসব ব্রাহ্মণ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে প্রাচীনত্বের ছাপ। সুতরাং প্রাঞ্জল গদ্য ভাষায় রচিত কর্মকাণ্ড সম্বলিত ব্রাহ্মণ গ্রন্থ বৈদিক সাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন।
আরণ্যক
আরণ্যক হল ব্রাহ্মণের উপসংহারভাগ। কীরূপ আচার সম্পন্ন হলে কীরূপে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হতে পারে, এবং ব্রহ্মই বা কী—আরণ্যকে তাই বর্ণিত হয়েছে। মহর্ষি মনুর মতে বেদপাঠ সমাপ্ত করেই আরণ্যক অধ্যয়ন করতে হয়। প্রত্যেক ব্রাহ্মনের একখানি করে আরণ্যক রয়েছে। ঋগ্বেদের যেমন দুটি ব্রাহ্মণ, তেমনি দুটি আরণ্যক রয়েছে—ঐতরেয় এবং কৌষীতকী। কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের তৈত্তিরীয় আরণ্যক, শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণের আরণ্যকের নাম বৃহদারণ্যক। সামবেদ এবং অথর্ববেদের আরণ্যক নেই অথবা পাওয়া যায়নি। ঐতরেয় আরণ্যকে ঋগ্বেদের প্রত্যেক ঋষির পরিচয় আছে। ঐতরেয় আরণ্যকেই ঋগ্বেদের সূক্ত, পদ, পদাংশ, শব্দ, শব্দাংশ প্রভৃতির সংখ্যা নির্ণয় দেখতে পাই।
উপনিষদ বা বেদান্ত
আরণ্যকের পর—উপনিষদ। আরণ্যকই উপনিষদের মূলীভূত। আরণ্যকে ব্রহ্মতত্ত্বের যে মূলসূত্র নিহিত আছে, উপনিষদে তাই বর্ণিত হয়েছে। বৈদিক সাহিত্যের অন্ত বা শেষভাগের কথা উপনিষদে থাকার জন্য উপনিষদকে বেদান্ত বলা হয়। সংহিতা, ব্রাহ্মণ বা আরণ্যকের সঙ্গে যুক্ত প্রায় দুই শত উপনিষদের নাম পাওয়া যায়। ভাষ্যকার শংকরাচার্য দশটি উপনিষদের কতা বলেছেন—ঈশ, কঠ, তৈত্তিরীয়, বৃহদারণ্যক, শ্বেতাশ্বতর, ঐতরেয়, কৌষীতকী, ছান্দোগ্য, কেন এবং প্রশ্নোপনিষদ। এছাড়াও শংকরাচার্য আরো দুটি উপনিষদকে প্রামাণ্য বলে ব্রহ্মসূত্রে উল্লেখ করেছেন—মুণ্ডক ও মাণ্ডুক্য উপনিষদ। ব্রহ্মতত্ত্ব নিরূপণের জন্য উপনিষদে যে বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে সেগুলির মধ্যে চারটি প্রধান বিষয় হল—ক) আত্মার বিশ্বব্যাপকতা, খ) আত্মার দেহান্তর গ্রহণ, গ) সৃষ্টিতত্ত্ব, ঘ) লয়-রহস্য
উপনিষদের প্রধান লক্ষ্য হল ব্রহ্ম বা আত্মার অদ্বিতীয়ত্ব এবং ব্রহ্মজ্ঞান বা আত্মজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন। উপনিষদের সর্বব্যাপী প্রভাব যথেষ্ট। শংকরের অদ্বৈতবাদ, রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, মধ্বের দ্বৈতবাদ প্রভৃতি বেদান্ত দর্শনের মূল ভিত্তি উপনিষদ। পাশ্চাত্যের দার্শনিক শোপেনহাওয়ার উপনিষদের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন শান্তি সান্ত্বনা। তাই বলে উপনিষদ মানুষকে কর্মবিমুখ বা পলায়নপর দৃষ্টিভঙ্গির লথাও বলেননি। উপনিষদে আছে ঋত ও সত্যে প্রতিষ্ঠিত বলিষ্ঠ জীবনের কথা, সমস্ত ভেদাভেদ, সমস্ত সংকীর্ণতা ও অন্যায়ের ঊর্ধ্বে মৈত্রী, প্রীতি, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের কথা।
বেদাঙ্গ
সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষৎ হল বৈদিক সাহিত্য। কিন্তু বেদপাঠ সহায়ক বা বেদ উপলব্ধির সহায়ক হল বেদাঙ্গ। বেদ অধ্যয়নের সহায়তাকারী বলে বেদাঙ্গ নাম। প্রধানত বেদের ছয়টি অঙ্গ উড়বেদাঙ্গ নামে পরিচিত—১) শিক্ষা, ২) ছন্দস্, ৩) ব্যাকরণ, ৪) নিরুক্ত, ৫) জ্যোতিষ, ৬) কল্পসূত্র। শিক্ষা হল প্রথম বেদাঙ্গ। বৈদিক সূক্তসমূহ কীরূপ স্বরে উচ্চারণ করা কর্ত্যব্য, শিক্ষা গ্রন্থে তাই বর্ণিত হয়েছে। বেদমন্ত্রের উচ্চারণে ছন্দের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বৈদিক মন্ত্রসমূহ যেহেতু ছন্দোবদ্ধ রচনা, তাই ছন্দজ্ঙানের জন্য এই গ্রন্থ। সম্যকভাবে বেদ উপলব্ধি করার জন্য শব্দ ও পদের ব্যুৎপত্তি জানা আবশ্যক। তাই শব্দ ও পদের জ্ঞানের জন্য প্রয়োজন ব্যাকরণ। নিরুক্ত হল বৈদিক শব্দকোষ বা মন্ত্রভাষ্য।
বৈদিক মন্ত্রপদের অর্থ জানার জন্য নিরুক্তের প্রয়োজন। বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের কাল নিরূপক কালচক্র বা জ্যোতিষচক্রের জন্যই জ্যোতিষশাস্ত্র। কোন যজ্ঞ কোন সময়ে হবে, সে বিষয়ে জ্ঙান অর্জনের জন্য জ্যোতিষশাস্ত্রের একান্ত প্রয়োজন। উপনিষদের পর অথবা উপনিষদ প্রচারের সমকালে সূত্র গ্রন্থ সমূহ রচিত হয়েছিল। যিনি যত সংক্ষিপ্ত আকারে সূত্র রচনা করে তার মধ্যে যতটা বেশি পরিমাণে তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, তার সূত্র সমকালে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল। বর্তমান যুগে ক্রিয়াকর্মে ব্যবহূত সূত্রগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়—শ্রৌতসূত্র, ধর্মসূত্র, এবং গৃহ্যসূত্র। শ্র্রৌত্যসূত্রে যাজযজগঞ, বলিদান প্রভৃতির আচার বিধান রয়েছে। কীরূপ নিয়ম-কানুন পালন করে সমাজে বসবাস করতে হয়—তা ধর্মসূত্রে বর্ণিত হয়েছে। গৃহ্যসূত্রে পিতা, মাতা, পুত্র, পতি প্রভৃতির পরস্পরের প্রতি কর্ম বর্ণিত আছে। শ্রৌত্যসূত্র, ধর্মসূত্র এবং গৃহ্যসূত্র একত্রে ‘কল্পসূত্র’ নামে বর্ণিত হয়।
Leave a Reply