//
//

ভাষা সংযোগ বলতে কী বোঝ, আলোচনা কর।

ভাষাসংযোগ

মিশ্রভাষা ও ভাষাঋণ

যখন এক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী অন্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে গিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করে অথবা এক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী নিজের প্রান্ত এলাকায় অন্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগে আসে তখন ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি নানা স্বাভাবিক কারণে একাধিক ভাষার মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়; তখন পারস্পরিক ভাব-বিনিময়ের জন্যে এক ভাষাসম্প্রদায়ের লোকে অন্য ভাষাসম্প্রদায়ের ভাষা বলতে ও বুঝতে চেষ্টা করে। এর ফলে ভাষার পরিবর্তনের ধারায় নানা প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়। এই সব প্রক্রিয়ার মধ্যে মিশ্রভাষা সৃষ্টি (Creation of Mixed Language), দ্বিভাষিকতা (Bilingualism), বহুভাযিকতা (Polyglottism/Multi lingualism), ভাষাঋণ (Borrowing) ইত্যাদি প্রধান। অবশ্য দ্বিভাষিকতা, বহুভাষিকতা ও ভাষাঋণ উপযুক্ত গোষ্ঠীগত সংযোগ ছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিক্ষার প্রয়োজনেও সাধিত হতে পারে। যেমন—মনীষী হরিনাথ দে, আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, নলিনীকান্ত গুপ্ত, প্রণবেশ সিংহরায় প্রভৃতি পণ্ডিতের বহুভাষিকতা জনগোষ্ঠীগত সংযোগ নয়, বহুভাষা-প্রীতির বশে ব্যক্তিগত উদ্যোগেই সাধিত। দ্বিভাষিকতা ও বহুভাষিকতা থেকে মিশ্রভাষা সৃষ্টির তফাৎ এই যে, দ্বিভাষিকতা ও বহুভাষিকতা ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও ভাষাগোষ্ঠীগত সংযোগ দুই কারণেই সাধিত হতে পারে, কিন্তু মিশ্রভাষাসৃষ্টি সাধারণত গোষ্ঠীগত সংযোগের ফলেই সাধিত হয়। এছাড়া দুটি প্রক্রিয়ার মধ্যেও পার্থক্য আছে। খাঁটি দ্বিভাষী, বা বহুভাষী লোকেরা যে ভাষা যখন বলে শুধু সেই ভাষাটিই তারা তখন অবিমিশ্রভাবে বলে এবং তারা একাধিক ভাষা বিশুদ্ধভাবে জানে ও বলতে পারে। কিন্তু মিশ্র ভাষার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, একাধিক ভাষার মিশ্রণে একটি নতুন ‘খিচুড়ি’ জাতীয় বিকৃত মিশ্রভাষা তৈরি হয় এবং তাতে একাধিক ভাষার উপাদান একই সঙ্গে ব্যবহৃত হয়। এই জাতীয় মিশ্রভাষা শুধু কাজ-চালানো-গোছের ভাষা (Make-shift_language), এতে কোনো উচ্চমানের ভাব-বিনিময় বা সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। শিক্ষিত লোকের কাছে এই জাতীয় কৃত্রিম ভাষা হাসির উদ্রেক করে। সাহিত্যেও এই জাতীয় ভাষা হাস্যরস সৃষ্টির জন্যে তুলে ধরা হয়। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘খট্টাঙ্গ ও পলান্ন’ গল্পে খাটের ব্যবসায়ী একটি চীনেম্যানের সঙ্গে একটি বাঙালি ছেলের দরকষাকষির মধ্যে চীনা উচ্চারণ, বাংলা বাক্যগঠনরীতি ও ইংরেজি শব্দের মিশ্রণে সৃষ্ট একটি অদ্ভুত মিশ্রভাষার চমৎকার নমুনা পাওয়া যায়। বাংলায় ভাষামিশ্রণের সবচেয়ে বেশি হাস্যজনক নিদর্শন পাওয়া যায় বাংলা হিন্দি মিশ্রণে। পরশুরামের লম্বকর্ণ গল্পে এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

ভাষাঋণ আবার দ্বিভাষিকতা, বহুভাষিকতা ও মিশ্রভাষা সৃষ্টি থেকে পৃথক একটি প্রক্রিয়া। এতে যে একই ব্যক্তি একাধিক ভাষ্ণ বিশুদ্ধ ভাবে বলতে পারে, তা নয়; বা এতে যে একাধিক ভাষার উপাদান মিশ্রিত করে একটি বিকৃত ভাষা সৃষ্টি হয়, তাও নয়। এতে একটি ভাষা স্ব-স্বরূপে প্রায় অবিকৃত থাকে, শুধু অন্য ভাষা থেকে কিছু উপাদান তাতে গৃহীত হয়ে যায়। মিশ্র ভাষায় একাধিক ভাষার উপাদানের মিশ্রণের ফলে একটি বিকৃত ভাষার সৃষ্টি হয়। কিন্তু ভাষাঋণ প্রক্রিয়ায় একটি ভাষা অন্য ভাষা থেকে উপাদান নিয়ে নিজের গঠনে তাকে আত্মসাৎ (assimilate) করে ফেলে। এতে ভাষার আংশিক মিশ্রণ হয় বটে, কিন্তু কোনো ভাষার বিকৃতি হয় না, একটি ভাষা বরং সমৃদ্ধ হয়।

মিশ্রভাষা

ব্যবসায়িক বা অন্যবিধ প্রয়োজনে দু’টি ভাষাসম্প্রদায়ের লোক পাশাপাশি থাকতে গিয়ে যখন তাদের উভয়ের ভাষা থেকে নির্বিচারে উপাদান গ্রহণ করে ফেলে এবং একটি প্রায় বিকৃত নিম্নমানের ভাষার সৃষ্টি করে তখন তাকে মিশ্রভাষা (Mixed Language/Jargon) বলে। পৃথিবীতে যেসব মিশ্রভাষা প্রচলিত আছে, তাদের মধ্যে এই চারটি প্রধান—বীচ-লা-মার (Beach-La Mar/Beche-La-Mar), fototal a faitstal_gets (Pidgin/Pidgin English), মরিশাস ক্রেওল (Mauritius Creole) এবং চিনুক (Chinook)। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মূলত ইংরেজি ভাষার সঙ্গে অল্পস্বল্প স্পেনীয় ও পর্তুগীজ ভাষার উপাদান মিশ্রিত হওয়ার ফলে বীচ-লা-মার মিশ্রভাষাটি গড়ে উঠেছে। এই ভাষায় শব্দের কারক-বিভক্তি অনুযায়ী রূপভেদ নেই, তেমনি ক্রিয়ার কাল-পুরুষবচন ভেদ নেই। উদাহরণ—সে খাচ্ছে = he kaikai, সে সব খেয়েছে = he kaikai all finish। পিজিন (Pidgin) মূলত চীনে প্রচলিত, জাপানেও এর কিছু প্রচলন আছে। এটি ইংরেজি ও চীনা ভাষার মিশ্রণে গড়ে উঠেছে। উদাহরণ—তুমি ভাল আছ? = You belong ploper (এখানে proper-এর স্থানে ploper হয়েছে, ‘র’ স্থানে ‘ল’ হয়েছে, কারণ চীনা ভাষায় ‘র’ নেই।) মরিশাস দ্বীপে মরিশাস ক্রেওল প্রচলিত। ফরাসি ভাষার সঙ্গে নিগ্রোদের ভাষার মিশ্রণে এই মিশ্রভাষার সৃষ্টি। এতেও শব্দের বা ক্রিয়ার রূপভেদ নেই। যেমন আমি খাবো—mo va manze; আমি খেয়েছিলাম—mo té manzé। উত্তর আমেরিকার ওরেগন অঞ্চলে চিনুকের প্রচলন দেখা যায়। আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের ভাষা নুটকা চিনুকের সঙ্গে মূলত ইংরেজির মিশ্রণে চিনুক মিশ্রভাষার সৃষ্টি। যেমন—তিন = ক্লোন, শুষ্ক = ৎলাই।

ভাষাঋণ (Borrowing)

ভাষা সংযোগের ফলে ভাষার পরিবর্তনের ধারায় যেসব প্রক্রিয়া সংঘটিত হয় তাদের মধ্যে অন্যতম হল ভাষাঋণ (Borrowing)। যখন দু’টি ভাষাগোষ্ঠী ব্যবসায়িক, ভৌগোলিক অবস্থানগত, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক কারণে পরস্পরের সংযোগে আসে তখন তাদের ভাষার যদি মানগত বিকৃতি সাধন না করেও একটি ভাষার লোক অন্য ভাষার কিছু উপাদান (শব্দ, বাক্যাংশ, বাক্য, উচ্চারণরীতি ইত্যাদি) তার নিজের ভাষার কোনো ঘাটতি পূরণ, বৈচিত্র্য সাধন, মান উন্নয়ন বা সম্মান বৃদ্ধির জন্যে নিজের ভাষায় গ্রহণ করে এবং গৃহীত উপাদানটি যদি পুরোপুরি ঐ ভাষায় প্রচলিত হয়ে যায় তাহলে সেই প্রক্রিয়াকে ভাষাঋণ (Borrowing) বলে। যে ভাষা থেকে ঐ উপাদানটি গ্রহণ করা হয় তাকে দানকারী ভাষা (donor language) বলে; যে ভাষায় ঐ উপাদানটি গ্রহণ করা হয়, তাকে গ্রহণকারী ভাষা (borrowing language) বলে। আর যে উপাদানটি গ্রহণ করা হয় তাকে গৃহীত আদর্শ (model) বলে।

ভাষাঋণ প্রক্রিয়াটি যেসব সর্তে বা পরিস্থিতিতে সংঘটিত হয় তাদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য হল দুটি ভাষার মধ্যে সংযোগ। একটি জাতির লোক অন্য জাতিকে রাজনৈতিক দিক থেকে অধিকার করলে, এক দেশের লোক ব্যবসাবাণিজ্য বা শিক্ষার জন্যে অন্য দেশে গিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করলে দুটি। ভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়। তখন এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় ঋণ গৃহীত হয়। দ্বিতীয়ত, হকেটের (Hockett) মতে, ভাষাগুলির মধ্যে আংশিক সাদৃশ্য ও আংশিক বৈসাদৃশ্য থাকা চাই। কারণ, তাঁর মতে, ভাষাগুলির মধ্যে আংশিক সাদৃশ্য না থাকলে এক ভাষার লোক অন্য ভাষার কিছুই বুঝতে পারবে না এবং বুঝতে না পারলে ভাষাঋণ গৃহীত হবে না। কিন্তু হকেট কথিত এই সর্তটি পুরোপুরি স্বীকার করা যায় না। কারণ, অনেক সময় ভাষাগুলির মধ্যে কোনো সাদৃশ্য না থাকলেও পরিস্থিতির চাপে, ইঙ্গিতে ইসারায় বা নিত্য ব্যবহারে অন্য ভাষার কিছু কিছু শব্দের অর্থ আমরা বুঝে নিই এবং তাকে নিজের ভাষায় গ্রহণ করি, তাতে ভাষাঋণ সংঘটিত হয়। যেমন, চীনা ভাষার সঙ্গে বাংলা বা ইংরেজি ভাষার কোনোই সাদৃশ্য নেই, কিন্তু চীনা ভাষা থেকে ‘চা’ শব্দটি বাংলায় এসেছে, চীনা ভাষা থেকে ‘টাইফুন’ (typhoon = বিশেষ এক শ্রেণীর ঝড়) শব্দটি ইংরেজিতে গৃহীত হয়েছে। সুতরাং দুটি ভাষার মধ্যে আংশিক সাদৃশ্য না থাকলে একটি ভাষা থেকে অন্যটিতে ভাষাঋণ গৃহীত হতে পারে না এমন সর্ত স্বীকার্য নয়। তবে একটি ভাষা থেকে অন্য ভাষায় ঋণ-গ্রহণ সংঘটিত হবার জন্যে ভাষা দুটির মধ্যে অন্তত আংশিক পার্থক্য থাকা অবশ্যই দরকার। ভাষাঋণ সংঘটিত হবার জন্যে তৃতীয় সর্ত হল—ভিন্ন ভাষাভাষী লোকের মধ্যে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় উপাদান গ্রহণের মনোভাব বা ইচ্ছা (motive) চাই। এই মনোভাব আবার দ্বিবিধ হতে পারে বলে হকেট উল্লেখ করেছেন—সামাজিক সম্মান লাভের মনোভাব (Prestige Motive) ও অভাব পূরণের মনোভাব (Need-feeling Motive)। কিন্তু এর সঙ্গে আরো একটি মনোভাব কাজ করে। সেটি হল বৈচিত্র্য সাধনের মনোভাব (Variation Motive)।

যখন একটি জাতি অন্য কোনো উন্নত জাতির সংস্পর্শে আসে সে মনে করে যে, যে জাতির সংস্পর্শে সে এসেছে সে জাতি তার চেয়ে উন্নত, তখন সেই উন্নত জাতির ভাষা-সংস্কৃতি সে অনুকরণ করে এবং এর ফলে নিজের ভাষার শব্দভাণ্ডার তার কাছে হেয় মনে হয়, নিজের ভাষার শব্দের বদলে সে উন্নত জাতির শব্দ ব্যবহার করে। যেমন—দু’জন আধুনিক শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে একজন যখন অন্য জনের কাছে নিজের স্ত্রীকে পরিচিত করিয়ে দেন তখন তিনি বলেন-ইনি আমার ওয়াইফ (wife), বা ইনি আমার মিসেস। ইনি আমার ‘স্ত্রী’ বা ‘পরিবার’ বললে যেন তার গ্রাম্য মনে হয়। এখানে স্ত্রীকে ‘ওয়াইফ’ (wife) বলার মূলে আছে শিক্ষিত বলে সম্মান লাভের ইচ্ছা। পূর্ববাংলার লোকে যখন নিজেদের দেশীয় উচ্চারণ ‘দ্যাশ’ ছেড়ে ‘দেশ’ উচ্চারণ করে তখনো একই রকম মনোভাব কাজ করে। এইসব ভাষাঋণের পেছনে সামাজিক সম্মান লাভের মনোভাবটি কাজ করেছে।

যখন এক জাতির কোনো নতুন ব্যবহার-সামগ্রী বা সাহিত্য-সংস্কৃতির কোনো বিষয় অন্য জাতি গ্রহণ করে—যা তার নিজের সমাজ-সংস্কৃতিতে ছিল না—তখন সেটি প্রকাশ করার জন্যে উপযুক্ত নাম তার নিজের ভাষায় থাকে না, তখন অনেক সময় ঐ ঘাটতি পূরণের মনোভাব থেকে সে সেই জিনিস বা বিষয়টির সঙ্গে মূল ভাষা থেকে তার নামটিও নিজের ভাষায় গ্রহণ করে। যেমন আমাদের সমাজে আগে চায়ের ব্যবহার ছিল না, চীনাদের কাছ থেকে আমরা যখন চায়ের ব্যবহার শিখলাম (যদিও পরোক্ষভাবে) তখন আমরা চীনা ভাষা থেকে ‘চা’ শব্দটিও বাংলায় গ্রহণ করলাম। তেমনি আমাদের দেশে প্রাচীন সাহিত্যে ট্রাজেডি ছিল না, ইংরেজির প্রভাবে আমাদের সাহিত্যে যখন ট্রাজেডি লেখা ও অভিনয় করা শুরু হল তখন ইংরেজি থেকে আমাদের ভাষায় ‘ট্রাজেডি’ শব্দটিও চালু হয়ে গেল।

ভাষাঋণের প্রকারভেদ

এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় উপাদান যে গ্রহণ করা হয় সেই প্রক্রিয়ার প্রকৃতি নানা রকম হতে পারে। প্রক্রিয়ার এই প্রকৃতি অনুযায়ী ভাষাবিজ্ঞানীরা ভাষাঋণের কয়েকটি শ্ৰেণি নির্ণয় করেছেন। প্রথমত ভাষাঋণকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করে নিয়ে তার পরে ভাষাঋণের প্রধান প্রধান প্রকারভেদগুলি সম্পর্কে আলোচনা করতে পারি। ভাষাঋণের প্রাথমিক দুটি বিভাগ হল—অবিমিশ্র ঋণ (Unmixed Borrowing) ও মিশ্র ঋণ (Mixed / Hybrid Borrowing)।

অবিমিশ্র ঋণ

যখন কোনো ভাষায় অন্য ভাষার কোনো উপাদান সবটা অবিমিশ্র আকারে গ্রহণ করা হয় তখন তাকে অবিমিশ্র ভাষাঋণ (Unmixed Borrowing) বলতে পারি। যেমন বাংলায় ইংরেজি থেকে গৃহীত হয়েছে ‘চেয়ার’ (Chair), কলেজ (College) ইত্যাদি।

মিশ্র ঋণ

যখন কোনো ভাষায় অন্য ভাষার কোনো উপাদানের সবটা গ্রহণ করা হয় না, কোনো উপাদানের অংশবিশেষ গ্রহণ করা হয় বা একটা কোনো উপাদান গ্রহণ করে তার সঙ্গে নিজের ভাষার উপাদান যোগ করে একটা নতুন মিশ্র উপাদান তৈরি করা হয় তখন সেই প্রক্রিয়াকে মিশ্র ভাষাঋণ গ্রহণ (Mixed Borrowing) বলে। আংশিক ঋণ গ্রহণের ফলে এইভাবে দুই ভাষার উপাদানের মিশ্রণে যে নতুন উপাদানটি গড়ে উঠে তাকে মিশ্রঋণ (Loan blend) বলা হয়। যেমন—বাংলায় ইংরেজি থেকে ‘মাস্টার’ (master) শব্দটি গ্রহণ করে তার সঙ্গে বাংলা ‘ই’ প্রত্যয়টি যোগ করা হল, এর ফলে পেলাম ‘মাস্টারি’। তেমনি ইংরেজি থেকে ‘রেল’ (rail) শব্দটি নিয়ে তার সঙ্গে বাংলা ‘গাড়ি’ যোগ করে হল ‘রেলগাড়ি’। এই রকম ভিন্নভিন্ন ভাষার উপাদানের সংমিশ্রণে গঠিত শব্দকে সঙ্কর শব্দ (Hybrid word) বলে। 

গৃহীত উপাদানের প্রকৃতি অনুযায়ী ভাষাঋণ আবার চার রকমের হতে পারে—(ক) শব্দঋণ (Loan word) (খ) অনূদিত ঋণ (Loan translation) (গ) অর্থ পরিবৃত্তি (Loanshift) এবং (ঘ) উচ্চারণ ঋণ (Pronunciation Borrowing)।

শব্দঋণ (Loan word)

এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় যখন কোনো শব্দ গৃহীত হয় তখন তাকে শব্দঋণ বা কৃতঋণ শব্দ (Loan word) বলে। ‘কৃতঋণ’ শব্দে ঋণদানকারী ভাষার ধ্বনি ও অর্থ কখনো কখনো প্রায় অবিকৃত থাকে। যেমন বাংলায় ইংরেজি থেকে গৃহীত শব্দ ‘চেয়ার’ (Chair), ‘কলেজ’ (College) ইত্যাদিতে রয়েছে। কিন্তু গৃহীত শব্দটি ঋণগ্রহণকারী ভাষার প্রভাবে বা তার কোনো শব্দের সাদৃশ্যে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। যেমন—ইংরেজি ‘টেব্‌ল’ (table) থেকে বাংলায় হয়েছে ‘টেবিল’, ইংরেজি ‘হসপিটাল’ (hospital) থেকে বাংলায় ‘হাসপাতাল’, ফরাসি ‘কূপ’ (Coupon) থেকে ইংরেজির মাধ্যমে বাংলায় ‘কুপন’। কোনো ভাষায় অন্য ভাষা থেকে গৃহীত উপাদানটি যখন গ্রহণকারী ভাষার গঠন-প্রকৃতি অনুযায়ী এমন পরিবর্তিত হয়ে যায় যে তার মূল স্বরূপটি বোঝা যায় না এবং তাকে গ্রহণকারী ভাষার নিজস্ব শব্দই মনে হয়, তখন তাকে স্বদেশীকৃত ঋণ (Naturalised or Adopted loan) বলে। যেমন—ইংরেজি lord থেকে বাংলা ‘লাট’, ইংরেজি lantern থেকে বাংলা ‘লণ্ঠন’, ইংরেজি chord থেকে বাংলা ‘কার’ (লাল কার, কালো কার), জার্মান Zar (ৎসার) থেকে বাংলা ‘জার’ ইত্যাদি।

অনুদিত ঋণ (Loan translation)

ঋণ-দানকারী ভাষা থেকে অনেক সময় শুধু একক শব্দ গ্রহণ না করে শব্দগুচ্ছ বা বাক্যাংশ বা বাক্যও গ্রহণ করা হয় এবং সেটিও মূল রূপে গ্রহণ করা হয় না, ঋণগ্রহণকারী ভাষার নিজস্ব উপাদানের সাহায্যেই ঋণদানকারী ভাষার গঠনের ছাদে বা প্রকাশরীতি অনুসারে তাকে অনুবাদ করে নেওয়া হয়। এই রকমের ভাষাঋণকে অনূদিত ঋণ (Loan translation) বলে। এখানে মূল উপাদানটা অন্য ভাষার নয়, শুধু তার গঠনরীতি বা প্রকাশরীতিটা অন্য ভাষার। যেমন—ইংরেজি থেকে বাংলায় lighthouse > বাতিঘর, university > বিশ্ববিদ্যালয়, cottage industry > কুটিরশিল্প, wrist-watch > হাতঘড়ি, neck-tie > গলাবন্ধ, May I come in? > আমি কি আসতে পারি? He will place his opinion now > এবার তিনি তার বক্তব্য রাখবেন। জার্মান থেকে Zeitgeist > কালপুরুষ।

অর্থপরিবৃত্তি (Loan shift)

অনূদিত ভাষাঋণে দেখা যায় যে, অন্য ভাষার কোনো শব্দ বা শব্দগুচ্ছকে একটি ভাষায় যে দেশীয় শব্দ বা শব্দগুচ্ছের সাহায্যে অনুবাদ করে নেওয়া হয় সেই সব দেশীয় শব্দগুচ্ছের প্রচলিত অর্থের তেমন কোনো পরিবর্তন সাধন করা হয় না, কারণ দেশীয় শব্দগুলির অর্থের সঙ্গে ঋণদানকারী ভাষার শব্দগুলির অর্থের মোটামুটি মিল থাকে। যেমন—wrist-watch শব্দে wrist-এর সঙ্গে হাতে’র এবং watch শব্দের সঙ্গে ঘড়ির প্রচলিত অর্থের মোটামুটি মিল আছে। এই জন্যে যখন ‘হাতঘড়ি’ শব্দটা তৈরি করা হল তখন ‘হাত’ বা ‘ঘড়ি’ কোনো শব্দেরই প্রচলিত অর্থের বিশেষ কোনো পরিবর্তন করা হল না। কিন্তু অর্থ পরিবৃত্তি (Loanshift) প্রক্রিয়ায় এমনটি হয় না। অর্থ পরিবৃত্তিতেও একটি ভাষায় কোনো অন্য ভাষার শব্দ গ্রহণ করা হয় না, কোনো নতুন জিনিস বা ভাবকে প্রকাশ করার জন্যে অন্য ভাষার শব্দের বদলে নিজের ভাষারই কোনো প্রচলিত বা অপ্রচলিত পুরানো শব্দ খুঁজে । বের করা হয়, কিন্তু তার পুরানো বা প্রচলিত অর্থটা ঝেড়ে ফেলা হয় এবং শব্দটাকে নতুন বিদেশি অর্থে ব্যবহার করা হয়। এখানে শব্দটা কোনো অন্য ভাষার শব্দ নয়, নিজের ভাষারই শব্দ, শুধু অন্য ভাষার কোনো শব্দের প্রভাবে তার অর্থের পরিবর্তন ঘটানো হয় বলে এই প্রক্রিয়াকে অর্থপরিবৃত্তি বলে। যেমন—আমাদের দেশে আগেও ‘আকাশবাণী’ শব্দটা প্রচলিত ছিল। কিন্তু তার অর্থ ছিল আকাশ থেকে উচ্চারিত দৈববাণী বা দেবতার সাবধানবাণী। আধুনিক যুগে যখন রেডিও-র প্রচলন হল তখন রবীন্দ্রনাথ ‘আকাশবাণী’র ঐ পুরানো অর্থ ত্যাগ করে শব্দটাকে নতুন যুগের জিনিস ‘রেডিও’ অর্থে প্রয়োগ করলেন। এখানে ‘আকাশবাণী’ শব্দটার অর্থ-পরিবর্তন ঘটল। কিন্তু এই পরিবর্তন ঘটল অন্য ভাষার শব্দ ‘রেডিও’র প্রভাবে। এই ধরনের প্রক্রিয়াকেই বলে অর্থপরিবৃত্তি। অর্থপরিবৃত্তির অন্যান্য উদাহরণ হল—airoplane অর্থে ‘বিমান’, mystic অর্থে ‘মরমিয়া’ শব্দের প্রয়োগ।

উচ্চারণ ঋণ (Pronunciation Borrowing)

অর্থপরিবৃত্তির বিপরীত প্রক্রিয়া হল উচ্চারণ ঋণ। অর্থপরিবৃত্তিতে একটি ভাষার নিজস্ব শব্দই নতুন যুগের উপযোগী করে গ্রহণ করা হয় তার অর্থের পরিবর্তন হয়ে যায়। আর উচ্চারণ ঋণেও নিজের ভাষার শব্দই থাকে, কিন্তু অর্থটা অপরিবর্তিত থাকে, শুধু উচ্চারণটাই অন্য ভাষার ছাঁদে পরিবর্তিত করে নেওয়া হয়। যেমন–অনেক শিক্ষিত লোক ‘সংস্কৃত’ কথাটিকে ইংরেজি ছাঁদে ‘স্যানসক্রিট’ উচ্চারণ করেন; বাংলায় যখন কথা বলে তখনো শব্দটার উচ্চারণ ওই রকম করে থাকে। যেমন—‘এখন স্যানসক্রিটের ক্লাস আছে।’ এই রকমের প্রক্রিয়াকে বলে উচ্চারণ ঋণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!