//
//

রূপক অলংকারের সংজ্ঞাসহ শ্রেণিবিভাগ করে প্রতিটি ভাগের বর্ণনা দাও।

রূপক

যে অলংকারে উপমেয়কে উপমানের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে উভয়ের মধ্যে অভেদ কল্পনা করা হয় তখন তাকে রূপক অলংকার বলে।

উদাহরণ:

দেখিবারে আঁখি পাখি ধায়।

ব্যাখ্যা: এখানে উপমেয়— আঁখি, উপমান— পাখি। উপমেয় ও উপমান এখানে বিসদৃশ বস্তু। কিন্তু কবির কল্পনায় আঁখি আর পাখি এক হয়ে গেছে। উভয়ের মধ্যে আর ভিন্নতা নেই। তাই এটি রূপক অলংকার।

রূপকের শ্রেণিবিভাগ

রূপক সাধারণত চারপ্রকার— নিরঙ্গ রূপক, সাঙ্গ রূপক, পরম্পরিত রূপক এবং মালা রূপক।

নিরঙ্গ রূপক

যে রূপক অলংকারে একটি মাত্র উপমেয়র সঙ্গে একটি মাত্র উপমানের অভেদ কল্পনা করা হয়, কিন্তু তাদের অঙ্গগুলির মধ্যে কোনো অভেদ কল্পনা করা হয় না তাকে নিরঙ্গ রূপক বলে।

উদাহরণ:

তোমার হৃদয়াকাশ অসীম বিজন।

ব্যাখ্যা: এখানে উপমেয়— হৃদয়, উপমান-আকাশ। হৃদয়ের সঙ্গে আকাশের অভেদ কল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু তাদের অঙ্গগুলির কোনো প্রকার উল্লেখ নেই বা তুলনা করা হয় নি। তাই এটি নিরঙ্গ রূপক। এটি আবার দুই প্রকার— কেবল রূপক, মালা রূপক।

© কেবল রূপক

যে রূপক অলংকারে একটিমাত্র উপমেয়র সঙ্গে একটিমাত্র উপমানের অভেদ কল্পনা করা হয় তাকে কেবল রূপক বলে।

উদাহরণ:

এমন মানব জমিন রইল পতিত

আবাদ করলে ফলতো সোনা।

ব্যাখ্যা: এখানে উপমেয়— মানব, উপমান— জমিন। এখানে একটিমাত্র উপমেয় জমিনের সঙ্গে একটিমাত্র উপমান মানবের অভেদ কল্পনা করা হয়েছে। তাই সংজ্ঞানুসারে এটি কেবল নিরঙ্গ রূপক।

© মালা নিরঙ্গ রূপক

যে রূপক অলংকারে একটি মাত্র উপমেয়র সঙ্গে একাধিক উপমানের অভেদ কল্পনা করা হয় তাকে মালা নিরঙ্গ রূপক বলে।

উদাহরণ:

হাথক দরপণ মাথক ফুল।

নয়নক অঞ্জন মুখক তাম্বুল।।

হৃদয়ক মৃগমদ গীমক সার।

দেহক সরবশ গেহক সার।।

ব্যাখ্যা: এখানে উপমেয় ১ টি— তুমি (শ্রীকৃষ্ণ), উপমান— দর্পণ, ফুল, অঞ্জন, তাম্বুল, মৃগমদ, হার, দেহসর্বস্বতা, গৃহ ও শ্রেষ্ঠত্ব। একটি উপমেয়র সঙ্গে আটটি উপমানের অভেদ কল্পনা করা হয়েছে তাই এটি মালা নিরঙ্গ রূপক।

সাঙ্গ রূপক

যে রূপক অলংকারে উপমেয় ও উপমানের অভেদ কল্পনার পাশাপাশি উপমেয়র বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সঙ্গে উপমানের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গেরও অভেদ কল্পনা করা হয়, তাকে সাঙ্গ (অঙ্গ সমেত) রূপক অলংকার বলে।

উদাহরণ:

শোকের ঝড় বহিল সভাতে

শোভিল চৌদিকে সুর সুন্দরীর রূপে

বামাকুল; মুক্তকেশ মেঘমালা;

ঘন নিশ্বাসপ্রবল বায়ু; অশ্রুবারিধারা।

আসার; জীমূত-মন্দ্র হাহাকার রব।

ব্যাখ্যা: এখানে মূল উপমেয়— শোক, মূল উপমান— ঝড়। মূল উপমেয় শোকের পাঁচটি অঙ্গ— বামাকুল, মুক্তকেশ, নিশ্বাস, অশ্রুবারিধারা, হাহাকার রব। মূল উপমান ঝড়ের অঙ্গও পাঁচটি— সুরসুন্দরী (বিদ্যুৎ), মেঘমালা, বায়ু, আসার, জীমূত-মন্দ্র। পাঁচটি অঙ্গসমেত মূল উপমেয় শোকের সঙ্গে পাঁচটি অঙ্গ সমেত মূল উপমান ঝড়ের অভেদ কল্পিত হওয়ায় উদাহরণটিতে সাঙ্গ রূপক অলংকার হয়েছে।

পরম্পরিত রূপক

যদি একটি উপমেয়র সঙ্গে একটি উপমানের অভেদ কল্পনা অন্য উপমেয়র সঙ্গে অন্য উপমানের অভেদ কল্পনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তবে পরম্পরিত রূপক অলংকার হয়।

উদাহরণ:

প্রবাসে দৈবের বশে জীবতারা যদি খসে

এদেহ আকাশ হতে।

ব্যাখ্যা: এখানে প্রথম রূপক ‘জীবতারা’। উপমেয় ‘জীব’ (জীবন) উপমান ‘তারা’। জীবনকে তারার সঙ্গে অভিন্ন করে দেখানোর কারণেই দেহকে আকাশ বলতে হয়েছে। অর্থাৎ প্রথম রূপকটি দ্বিতীয় রূপকের কারণ।

অধিকারূঢ়বৈশিষ্ট্য রূপক

‘অধিকারূঢ়বৈশিষ্ট্য’ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে হয়— অধিক + আরূঢ় + বৈশিষ্ট্য। অধিক অর্থে বাড়তি, অতিরিক্ত, অসম্ভব ইত্যাদি। আর আরূঢ় মানে চেপে বসা, চাপানো, আরোপিত করা। অর্থাৎ, বাড়তি বা অসম্ভব বৈশিষ্ট্য আরোপ করে যে রূপক তাই অধিকারূঢ়বৈশিষ্ট্য রূপক। এর সংজ্ঞা দেওয়া যায় এইভাবে—যে রূপক অলংকারে উপমানের ওপর কোনো অসম্ভব বৈশিষ্ট্য আরোপ করে তাকে উপমেয়র সঙ্গে অভেদ কল্পনা করা হয়, তাকে বলে অধিকারূঢ়বৈশিষ্ট্য রূপক।

উদাহরণ:

থির বিজুরি নবীনা গোরী পেখনু ঘাটের কুলে।

ব্যাখ্যা: এখানে ‘বিজুরীর’ (বিজলীর) বিশেষণ ‘থির’ (স্থির) হতে পারে না, স্থিরতা বিজলীর পক্ষে একটি অসম্ভব বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সেই অবাস্তব বৈশিষ্ট্যটি বিজলীর ওপর (উপমান) অধিক। আরূঢ় করে উপমেয় ‘গোরী’ (রাধা) আর সঙ্গে তার অভেদ কল্পনা করা হয়েছে। তাই এটি অধিকারূঢ়বৈশিষ্ট্য রূপক অলংকার হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!