লেবেডেফ ও তাঁর বেঙ্গলী থিয়েটার সম্পর্কে আলোচনা কর।

লেবেডেফ ও বেঙ্গলী থিয়েটার

উদ্বোধন: ২৭ নভেম্বর, ১৭৯৫

স্থায়িত্বকাল: ২৭ নভেম্বর, ১৭৯৫ থেকে ২১ মার্চ, ১৭৯৬

প্রতিষ্ঠাতা: গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেডেফ

নাটক: কাল্পনিক সংবদল (The Disguise)

ইংরেজি ধরনের নাট্যশালায় বাংলা নাটকের প্রথম অভিনয় অনুষ্ঠান হয় ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে। এই অভিনয়ের আয়োজন যিনি করেন, তিনি জাতিতে বাঙালিও নন, ইংরেজিও নন; তিনি রুশদেশীয় লেবেডেফ (১৭৪৯-১৮১৭)। তৎকালীন রাশিয়ার ইউক্রেন অঞ্চলের অধিবাসী তিনি। তাঁর পুরো নাম Gerasim Stepanovich Lebedlelf. লেবেডেফের নামের উচ্চারণ ‘হেরাসিম’ ও ‘গেরাসিম’—বাংলায় দু’রকম বানানেই দেখা যায়। লেবেডেফ-ও তাঁর নামের ইংরেজি বানানে কখনো Gerasim এবং কখনo Herasim লিখেছেন। আসল কথা, ইংরেজি ‘H’ রুশ ভাষায় ‘G’ দিয়েই উচ্চারণ করা হয়। রুশদেশবাসী লেবেডেফ এদেশে এসে ইংরেজিতে নিজের নাম লিখতে গিয়ে প্রাথমিক ভাষান্তরিতের দ্বিধা নিয়ে কখনো ‘H’ কখনো ‘C’ লিখে থাকতে পারেন। তবে Gerasim = Herasim হলেও, রুশীয় হিসেবে তাঁর নামের উচ্চারণ ‘গেরাসিম’ হওয়াই সঙ্গত। এবং ইংরেজি উচ্চারণ লেবেডেফ হলেও রুশীয় উচ্চারণ লিয়েবেদেফ্ হওয়াই সঙ্গত। যদিও তিনি নিজে বাংলায় লিখেছেন নিজের নাম লেবেডেফ।

ভাগ্যান্বেষী ও ভারতীয় ভাষা-সংস্কৃতি-দর্শন সম্পর্কে আগ্রহী লেবেডেফ ভারতে এসে প্রথমে মাদ্রাজে (১৭৮৫) বসবাস করেন, সেখানে তামিল ভাষা শেখেন। তারপরে কলকাতায় এসে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেন। ভারতীয় ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত হন। বাংলা ভাষায় আগ্রহী হয়ে তিনি গোলকনাথ দাসকে ভাষা শিক্ষক রেখে বাংলা ভাষা ভালোভাবে রপ্ত করেন। হিন্দি ভাষাও শিক্ষা করেন। কলকাতায় থাকাকালীন তিনি যন্ত্রশিল্পী হিসেবে সঙ্গীত শিক্ষা দিয়ে জীবিকা অর্জন করতেন। পিয়ানো ও ভায়োলিনবাদক হিসেবে তিনি খ্যাতিলাভ করেন। কখনো কখনো তিনি নৃত্যগীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেও অর্থোপার্জন করতেন।

কলকাতার ২৫ নম্বর ডোমটোলায় (বর্তমান ৩৭-৩৯ নম্বর এজরা স্ট্রিট) তিনি জগন্নাথ গাঙ্গুলী মহাশয়ের বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে নিজের উদ্যোগে একটি নাট্যশালা তৈরি করেন। নাম দেন ‘দি বেঙ্গলী থিয়েটার’ (The Bengally Theatre)। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই বেঙ্গলী থিয়েটারে লেবেডেফ ‘The Disguise’ নামে একটি ইংরেজি নাটকের বাংলা অনুবাদ অভিনয় করেন। প্রথম অভিনয় হয় শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে। ওই একই নাটকের দ্বিতীয় অভিনয় হয় সোমবার, ২১ মার্চ, ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে। তৃতীয়বার অভিনয়ের জন্য তিনি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেন। কিন্তু তার মধ্যেই তাঁর রঙ্গমঞ্চটি আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। তাই ‘The Disguise’-এর বাংলা রূপান্তর ‘কাল্পনিক সংবদল’ নাটকটিই এই থিয়েটারে দু’বার অভিনীত হয়। তাছাড়া অন্য কোনো নাটকের অভিনয় আর এখানে হয়নি।

লেবেডেফ যখন এই নাট্যাভিনয়ের চেষ্টা করেন, তখন সেই অষ্টাদশ শতকের শেষপ্রান্তে, কলকাতায় অবস্থানকারী ইংরেজরা নিজেদের প্রয়োজনে থিয়েটার তৈরি করে ইংরেজি নাটকের অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে রঙ্গমঞ্চ ও তার ব্যবস্থাদি, নাটকনাট্যকার, প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা, দর্শক সবই বিদেশী। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিককার এই সময়ে বিদেশী এই রঙ্গালয়গুলির সঙ্গে বাঙালির কোনো রকম যোগাযোগ ছিল না। লেবেডেফের নাট্য-প্রচেষ্টার সমসাময়িক এই রকম বিদেশী থিয়েটার একটি ‘দি নিউ প্লে-হাউস’ বা ‘দি ক্যালকাটা থিয়েটার’ অভিনয় করছে। কিন্তু ভালোভাবে চলছে না। ফলে নাট্যশালার কর্তৃপক্ষ ‘সাবসক্রিপসন’ পারফরমেন্স চালু করেছেন। অর্থাৎ আগে থেকেই চাঁদা তুলে সদস্য-দর্শক নিশ্চিত করে রাখা। তাতেও নাট্যশালার দুরবস্থা কাটছে না। কলকাতায় তখন বিদেশীদের সংখ্যাও তো খুব বেশী ছিল না।

লেবেডেফ তার রূপান্তরিত বাংলা নাটকটি এই ক্যালকাটা থিয়েটারেই অভিনয়ের জন্য আবেদন করেন। সেখান থেকে তাকে অপমানিত হয়ে ফিরতে হয়। তখন তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে ক্যালকাটা থিয়েটারের কাছাকাছি অঞ্চলেই তাঁর ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করেন।

এদিকে বাঙালি তখনো বিদেশী থিয়েটারে আসেনি। তারা তখনো যাত্রা-পাঁচালী, কবিগান, ঢপ-কীর্তন, কথকতা, তর্জা, ঝুমুরের আসরেই ভীড় জমাচ্ছে। বাঙালির নাট্যশালা বা বাংলা ভাষায় নাটকাভিনয় তখনো চালু হয়নি।

কিছু বাঙালি ধনী জমিদার ও বেনিয়া ইংরেজদের নাট্যশালায় উকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে। তাও নাট্যরসলাভে নয়, কৌতূহল মেটাতে। সাহেবদের সঙ্গে বসে সম্মানলাভের জন্য এবং প্রধানত স্ফূর্তির জন্য। আর বৃহত্তর যে বাঙালি যাত্রা-কবিগানের আসরে ভীড় জমাচ্ছে তাদের বিদেশী নাট্যশালায় গিয়ে নাটক দেখার যোগ্যতা কোন দিক দিয়েই নেই। ইংরেজি ভাষা এদের আয়ত্ত নয়, রঙ্গালয়গুলির উচ্চ দর্শনীমূল্য দেবার সামর্থ্য এদের নেই এবং সাহেব ভীতি—এদের রঙ্গালয় থেকে দূরে রেখেছে।

পলাশীর যুদ্ধের পর তখনো পঞ্চাশ বছর কাটেনি। কলকাতা তখনো শহর হয়ে ওঠেনি, উঠছে; এবং নতুন গঠিত শহরে বাঙালিরা ইংরেজদের ব্যবসায়ের সঙ্গে মিশে অর্থোপার্জন শুরু করেছেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (১৭৯৩) পর বাংলায় কৃষিনির্ভর জনজীবন বিপর্যস্ত হতে শুরু করেছে। কলকাতায় কঁচা পয়সার লোভে বাঙালির ভীড় বেড়েই চলেছে। নতুন সৃষ্ট কলকাতার এই বাঙালি জনসমাজ রুচি-সংস্কৃতি ইত্যাদিতে পুষ্ট ছিল না। এদের রুচির তাগিদেই কবিগানের আসর জাঁকিয়ে বসেছে। যাত্রাগানে কৃষ্ণলীলা আধ্যাত্মিক রস হারিয়ে নিম্নরুচির পর্যায়ে নেমে গেছে। নতুন বাবু সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হতে চলেছে।

এই অবস্থায় লেবেডেফ নাট্যাভিনয়ের প্রচেষ্টা করলেন। ইংরেজি নাট্যশালার দুরবস্থা তিনি দেখেছিলেন। সেখান থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। এবারে তাই তিনি যে নাট্যপ্রচেষ্টা করলেন, তাঁর নাটক ইংরেজি নাটক নয়, আবার যাত্রাও নয়। ইংরেজরা নিজেদের প্রয়োজনেই ইংরেজি নাটক করতো। বাঙালির কথা তাদের চিন্তায় ছিল না। লেবেডেফ ইংরেজ নন, তাই রাজার জাতের অহমিকা তাঁর ছিল না। এদেশের ভাষা শিখেছেন, এখানকার লোকদের প্রতি আগ্রহী হয়েছেন এবং তার ওপর ভাগ্যান্বেষণের প্রয়োজনে তিনি বুঝেছিলেন, ইংরেজ ও বাঙালি এই মিশ্র দর্শকমণ্ডলীর মতো নাটক করলেই চলবে। নচেৎ ক্যালকাটা থিয়েটারের মতো দুরবস্থা হবে। নতুন আমদানীকৃত সাহেবদের রঙ্গশালার আকর্ষণ এবং সেখানে বাংলায় নাটক অভিনয়-নতুন সৃষ্ট বাবু সম্প্রদায় এবং হঠাৎ নবাব ধনী বাঙালির উৎসাহ বৃদ্ধি করেছিল। আবার ১৮ শতকের শেষ দিকে কলকাতায় বসবাসকারী প্রবাসী ভাগ্যতাড়িত ইংরেজ ও হঠাৎ বড়লোক বাঙালি সম্প্রদায়ের মানসিকতার মিল রয়েছে অনেক দিকে। সস্তা আমোদ-প্রমোদ উপভোগ, কৌতুকরস আস্বাদন, নাচগান বাজনা এবং সর্বোপরি থিয়েটারের নবসৃষ্ট আকর্ষণ।

গোলকনাথ দাস প্রমুখ পণ্ডিতদের কাছে এদেশীয় ভাষা শিক্ষা শেষে লেবেডেফ দুটি ইংরেজি নাটকের বাংলায় অনুবাদ করেন। যে নাটক দুটি বাছাই করলেন, সে দুটিই হাল্কা কৌতুকরস-উচ্ছল। একটি মলিয়ের ‘Love is the Best Doctor’, অন্যটি ‘The Disguise’, রচয়িতা হলেন অষ্টাদশ শতকের অখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার রিচার্ডপল জড্রেল (১৭৪৫-১৮৩১)। নাটক দুটি অনুবাদের জন্য বাছাই করার কারণ জানিয়েছেন লেবেডেফ— ‘‘I translated two English dramatic pieces, namely, The Disguise, and Love is the Best Doctor, into the Bengali language; and having observed that the Indians preferred mimicry and drollery to plain grave solid sense; however purely expressed-I therefore fixed on those plays, and which were inost pleasantly filled up with a group of watchmen, chokeydars, savoyards, canera, thieves, ghoonia, lawyers, gumosta and amongst the rest a corps of petty plunderers’’. [A. Grammer of the pure and Mixed East Indian Dialects, (1801), Iutroduction.]

তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এদেশীয়রা গম্ভীর উপদেশাত্মক কথা যতো সুন্দর করেই বলা হোক না কেন, তা পছন্দ করে না। তারা পছন্দ করে অনুকরণ, হাসিতামাশা। সেজন্যই তিনি ঐ সমস্ত চোর-চৌকিদার-গোমস্তা-উকিল-ঘুনিয়া প্রভৃতি চরিত্রে নাটকটির মজা ভরিয়ে দিলেন। যেসব ছিল না মূল নাটকে তার অনেক কিছুই তিনি তৈরী করে নিলেন।

দুটি নাটকের অনুবাদ করলেও, অভিনয় করলেন কিন্তু একটি নাটকের। ‘The Disguise’ নাটকের বাংলা রূপান্তরের নাম দিলেন ‘কাল্পনিক সংবদল’। এই একটি নাটকের দুবার অভিনয় হলো। দুটি নাটকের অভিনয়ের কোনো প্রমাণ নেই।

লেবেডেফ ইংরেজি ও রুশীয় রঙ্গশালার মিশ্রণে নিজের রঙ্গমঞ্চের পরিকল্পনা করলেন। নিজে নক্সা তৈরি করলেন। সেইমত মঞ্চ ও প্রেক্ষাগৃহ নির্মিত হলো। অভিনয়ের ব্যাপারে তাঁকে সব রকমের সাহায্য করলেন তাঁর ভাষা শিক্ষক গোলকনাথ দাস। তাঁরই সহায়তায় বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রী জোগাড় করা হলো। দশ জন পুরুষ ও তিন জন মহিলা। গোলকনাথ দাস তখনকার ঝুমুরের দল থেকে অভিনেত্রীদের সংগ্রহ করে থাকতে পারেন। যেখান থেকেই এদের নেওয়া হোক, এরা কেউই ভদ্রসমাজের ছিল না। এর কিছু আগেই সাহেবদের থিয়েটারে (মিসেস ব্রিস্টোর থিয়েটার)—১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে মেয়েরা অভিনয় করতে শুরু করেছে।

এদের দিয়ে নাটক প্রস্তুত করে লেবেডেফ প্রথম বাংলা ভাষায় নাট্যাভিনয় করলেন। প্রথম রাত্রে অনূদিত নাটকটির ‘হ্রস্বীকৃত একাঙ্করূপ’ অভিনয় করেন। দ্বিতীয় রাত্রে তিন অঙ্কের পুরো অনুবাদটিই অভিনয় হয়। তাতে ১ম অঙ্ক বাংলায়, ২য় অঙ্কের ১ম দৃশ্য ‘মুর’ ভাষায়, ২য় দৃশ্য বাংলায়, ও ৩য় দৃশ্য হয় ইংরেজি ভাষায়। ৩য় অঙ্কের পুরোটিই বাংলাতে অভিনীত হয়। মুর ভাষা বলতে হিন্দুস্থানী ভাষা বোঝানো হয়েছে। তিন অঙ্কের নাটকটি আদ্যোপান্ত বাংলা ভাষায় কখনোই অভিনীত হয়নি। যদিও সে ইচ্ছা লেবেডেফের ছিল। ইংরেজি অংশ বাঙালিরা করেনি, সাহেবরা অভিনয় করেছিল, এমন অনুমান অসঙ্গত নয়। এইভাবে মিশিয়ে নাটক করলেন যাতে বাঙালি ও ইংরেজ উভয় শ্রেণীর দর্শকই তাঁর রঙ্গালয়ে আসে। সাহেব দর্শকদের জন্য আগে থেকেই বাংলা নাটকের ইংরেজি বিবরণ বিলি করা হয়েছিল, যাতে নাটক বুঝতে অসুবিধা না হয়। উভয় শ্রেণীর দর্শকের কথা তাঁকে ভাবতে হয়েছিল, কেননা, তখন দর্শক কম এবং একসঙ্গে দুটো রঙ্গালয় কলকাতায় চলা প্রায় অসম্ভব।

লেবেডেফের থিয়েটারের দর্শনীমূল্য তার সময়ের ক্যালকাটা থিয়েটারের তুলনায় কম ছিল। যদিও তা সাধারণ বাঙালির কাছে খুবই বেশি। প্রথম রজনীতে প্রবেশমূল্য ছিল—

বক্স—আট সিক্কা টাকা। গ্যালারি—চার সিক্কা টাকা।

দ্বিতীয় অভিনয়ে সব আসনের প্রতিটিই সদস্য-দর্শক হিসেবে এক মোহর ধার্য হয়েছিল। সে তুলনায় ক্যালকাটা থিয়েটারের প্রবেশমূল্য ছিল—

নীচের বক্স—ষোল সিক্কা টাকা। ওপর তলার বক্স—বারো সিক্কা টাকা। গ্যালারি—আট সিক্কা টাকা।

লেবেডেফের প্রচেষ্টায় চারটি সুমহান পরিকল্পনা বাঙালির নাট্যঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল—

১. নাট্যশালার নাম দিলেন বেঙ্গলী থিয়েটার।

২. বিজ্ঞাপন দিলেন—‘decorated in the Bengali Style’ বলে। অনেকে এই ‘Bengali Style’-কে বিজ্ঞাপনের চমক ছাড়া আর কিছু নয় বলে মনে করেছেন। তবে অনেকে মনে করেন, ‘Bengali Style’-মানে মঞ্চের বাইরেটা আল্পনা, মঙ্গল কলস, কলাগাছ দিয়ে সাজানো হয়েছিল এবং দৃশ্যপট বাংলাদেশের পরিবেশ অনুযায়ী সজ্জিত হয়েছিল। পরবর্তীকালেও ইংরেজি রঙ্গালয়ের মডেলে তৈরি বাঙালির নাট্যশালাতেও বাঙালিয়ানার বহিরঙ্গ মিশেল দেখতে পাওয়া যায়।

৩. বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দিয়ে অভিনয় করালেন।

৪. মূলত অভিনয় হলো বাংলা ভাষাতেই।

লেবেডেফ এই সময়কার বাঙালি ও ইংরেজ উভয় সম্প্রদায়ের জনচরিত্রকে জানতেন বলেই, তিনি ভাবসমুন্নত প্রেমের উচ্চ আদর্শের কমেডি বা বিষাদের মোহাচ্ছন্ন গভীর ট্রাজেডি নাটক নির্বাচন না করে ‘কমেডিয়া ডেল আর্ট’-এর ধরনে হাল্কা প্রণয়ের, রঙ্গের, স্থূল দেহপ্রেমের, সস্তা কৌতূহলের নাটকটি গ্রহণ করেছিলেন। অষ্টাদশ শতকের ইংরেজি কমেডির এই বিষয় ওই শতকেরই প্রান্তসীমায় বাংলাদেশের জনরুচিতে আদরণীয় হয়েছিল। প্রেমের ভুল বোঝাবুঝি, অভিমান, চরিত্রের নিজস্ব পরিচয় গোপন রেখে জটিলতা, পরিণামে রহস্য উন্মোচন, এবং মধুরেন সমাপয়েৎ—অতি সস্তা এই কমেডি ধরনের নাটক ‘The Disguise’। লেবেডেফ পূর্ণাঙ্গ নাটকটিকে তিন অঙ্ক দৃশ্যসম্বলিত সংক্ষিপ্ত রূপ দেন। মূল ইংরেজি রচনার পাশাপাশি রাশিয়ান ও বাংলা উভয় অনুবাদ সম্বলিত নাট্যরূপটি পাওয়া যায়।

মূল নাটকে যা কমতি ছিল, লেবেডেফ তা অনুবাদে যোগ করলেন। অনুবাদে মূলের যথাযথ অনুসরণ নেই, অনেকক্ষেত্রে নতুন কিছু তৈরি করে নিলেন। পাত্রপাত্রীদের নামকরণ করলেন বাংলায়। যেমন—Lews হল ভোলানাথ, Clara হল সুখময়ী, Beinardo—রামসন্তোষ ইত্যাদি। স্থাননাম Seville ও Madrid পরিবর্তিত হয়েছে কলকাতা ও লক্ষ্ণৌতে। মূলে নেই এমন অনেক বাড়তি চরিত্রের কথা তো আগেই বলেছি।

মূল নাটকে Musician-দের উল্লেখ রয়েছে। লেবেডেফ তার ওপরে বাড়তি নৃত্যগীতের সংযোজন করলেন। গাইয়্যা, বাজিয়্যা, নাচিয়া চরিত্রগুলি এই কারণে সৃষ্টি করলেন। পুরুষকান, মায়্যাকান ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে। গান যাদের ব্যবসা সেই সময়ে তাদের ‘কান’ (কিন্নর > কান) বলতো। যেমন প্রসিদ্ধ সঙ্গীত ব্যবসায়ী মধুকান। সঙ্গীতে লেবেডেফের উৎসাহ ছিল, ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় এসে তিনি সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। নাটকেও তিনি দেশী ও বিদেশী যন্ত্রসঙ্গীতের ব্যবহার করলেন। এবং ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ওকান্তরিত কবি ভারতচন্দ্র তখনো ভীষণ জনপ্রিয়। লেবেডেফ কবি ভারতচন্দ্রের কাব্যের প্রতি এতই আকৃষ্ট হন যে, তিনি ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যের রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। সেই ভারতচন্দ্রের দুটি গান তিনি তাঁর নাটকে যোজনা করলেন—

প্রথমটি,   প্রাণ কেমন রে করে না দেখে তাহারে

               যে করে আমার প্রাণ কহিব কাহারে।

দ্বিতীয়টি, গুণসাগরে নাগর রায়

নগর দেখিয়া যায়।

একক সঙ্গীত ও মিলিত সঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছিল। নাটকে উল্লেখ আছে ‘আরম্ভ করিল নাচিতে’ কিংবা ‘দুই মায়্যাকান গানবাদ্দী করে’। এক এক অঙ্কের বিরতিতে গান ও যন্ত্রসঙ্গীত দেওয়া হয়েছিল।

অভিনয়কে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য চরিত্রদের পোষাক ও মুখোস ব্যবহার করা হয়। বাবুর সাজসজ্জা, তোগা, পাখনা দেওয়া টুপি, ছড়ি ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া দৃশ্যসজ্জার বিবরণও নাটকটিতে রয়েছে।

প্রথমবারের অভিনয়ে নাট্যশালায় দর্শকসংখ্যা ছিল দু’শা। প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ হয়ে যায়। উৎসাহিত লেবেডেফ দ্বিতীয়বারের অভিনয়ে আসনসংখ্যা বাড়িয়ে তিনশো করেন এবং সদস্য-দর্শনী মূল্য করেন এক মোহর। তাতেও প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ হয়ে যায়। কৃতজ্ঞ লেবেডেফ সংবাদপত্র মাধ্যমে দর্শকদের অভিনন্দন জানান, এবং তৃতীয় অভিনয়ের উদ্যোগ আয়োজন করতে থাকেন।

কিন্তু তার এই সাফল্যে তৎকালীন ইংরেজদের ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’ কর্তৃপক্ষ খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। ইংরেজ ও বাঙালি দুই ধরনের দর্শক আকর্ষণ করে, অভিনয়ে বাঙালি মেয়েদের নামিয়ে এবং নাটক মজা-ফুর্তিতে ভরিয়ে দিয়ে লেবেডেফ মাৎ করে দিয়েছিলেন। ঈর্ষান্বিত ক্যালকাটা থিয়েটারের কর্তৃপক্ষের পক্ষে বিজাতীয় রুশবাসীকে সহ্য করা সম্ভব হয়নি। লেবেডেফের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্যালকাটা থিয়েটারের টমাস রোওয়ার্থ-এর নির্দেশে দৃশ্যপটশিল্পী ও বাজনাদার জোসেফ ব্যাটল লেবেডেফের হিতৈষী সেজে বেঙ্গলী থিয়েটারে যোগ দেন এবং ক্রমে লোক ভাঙিয়ে লেবেডেফকে দুর্বল করে দেন। অনেকেই এই চক্রান্তে যোগ দেন। প্রথমে অভিনেতা অভিনেত্রীরা চক্রান্তের শিকার হয়ে লেবেডেফের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করে চলে যায়। লেবেডেফ পরে ব্যাপারটি বুঝতে পারেন। চলে যাওয়া নটনটীদের বিরুদ্ধে কোম্পানীর আদালতে অভিযোগ করেন। কিন্তু সেখানেও চক্রান্তের শিকার হলেন। কোনো ইংরেজ ব্যবহারজীবী তার পক্ষে মামলা চালাতে রাজি হলেন না। তবুও তিনি অভিনয় চালাবার জন্য নবোদ্যমে অভিনেতা অভিনেত্রী জোগাড় করে অভিনয়ের ব্যবস্থা করার মুখে ইংরেজ থিয়েটার ব্যবসায়ীদের চক্রান্তে তাঁর বেঙ্গলী থিয়েটার ভস্মীভূত হয়ে যায় (মে, ১৭৯৭)। আর্থিক দিক দিয়ে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। তবুও তিনি এরপরে মঞ্চ সংস্কার করে ‘The Deserter’ নামে একটা অপেরা মঞ্চস্থ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাও ব্যর্থ হলো। তখন মঞ্চের সব উপকরণ বিক্রি করে দিয়ে একেবারে নিঃস্ব ও ভগ্নোদ্যম হয়ে নাটকাভিনয়ের চেষ্টা ছেড়ে দিলেন। আশাহত লেবেডেফ ভারতবর্ষ ছেড়ে ইংলন্ড চলে যান, সেখান থেকে নিজদেশ রাশিয়ায় ফিরে যান, সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়, ১৫ই জুলাই, ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে।

লেবেডেফের নাট্যপ্রচেষ্টার ব্যর্থতা ও সার্থকতা সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। উনিশ শতকে বাঙালির নবজাগ্রত নাট্যবোধ গড়ে ওঠার অনেক আগেই রুশদেশবাসী লেবেডেফ নাট্যশালা তৈরি করে বাংলায় নাটকাভিনয় করেন। তাঁর নাটকের ভাষার দুরূহতা, দুর্বোধ্যতা ও আড়ষ্টতা কোনো দর্শকের পক্ষেই সহজবোধ্য ছিল না। সাধারণ বাঙালি দর্শকের উপভোগের বিষয়ও হতে পারেনি। তারা সে নাট্যাভিনয় দেখেওনি। অনেক সমালোচক তাই লেবেডেফের এই নাট্যপ্রচেষ্টাকে পরবর্তী বাঙালির নাট্যপ্রচেষ্টার সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারেননি। পরবর্তী বাঙালির উৎসাহ ও রুচির সঙ্গে এর যোগ ছিল না বলেও কেউ কেউ মনে করেছেন। রঙ্গমঞ্চে লেবেডেফ বাংলা নাটকের শুধু অভিনয়ই করেছেন, নাট্যবোধ কিংবা উৎসাহ তিনি বাঙালির মধ্যে জাগাতে পারেননি বলেও অনেকে মনে করেছেন।

লেবেডেফ ও তাঁর বেঙ্গলী থিয়েটারের সীমাবদ্ধতা

ঘটনাগতভাবে একথা ঠিক যে, লেবেডেফের ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’ কোনো ব্যাপক নাট্য আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। লেবেডেফ এককভাবে চেষ্টা করেছিলেন মাত্র। ১৮ শতকের একেবারে অন্তিম লগ্নে তাঁর এই প্রচেষ্টা ১৯ শতকের নবোদ্ভাবিত বাঙালির নবজাগরণের প্রাণচাঞ্চল্যে কোনো সাড়া ফেলতে পারেনি। তার কয়েকটি কারণ বলা যেতে পারে—

  • লেবেডেফের ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’ একেবারেই ক্ষণস্থায়ী থিয়েটার। এখানে মাত্র একটি নাটকের দুইবার অভিনয় হয়। তারপর ধারাবাহিকতার পথ বেয়ে লেবেডেফ-এর মতো অন্য কারো প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। ধারাবাহিকতার ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়নি।
  • লেবেডেফের থিয়েটারের প্রবেশ মূল্য সাধারণ বাঙালির ক্ষমতাতিরিক্ত ছিল।
  • লেবেডেফের সময়ে ইংরেজি শিক্ষা সেভাবে এদেশে চালু হয়নি। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা (১৮১৭), সেকালের ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের নীতি (১৮৩৫) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা (১৮৫৭) অনেক পরের ঘটনা। ইংরেজি নব্যশিক্ষিত বাঙালির তখনো আবির্ভাব হয়নি।
  • ১৮ শতকের শেষপ্রান্তে বাংলায় মধ্যবিত্ত বাঙালির উদ্ভব হয়নি। যে কোন সংস্কৃতির মতোই নাট্য সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মধ্যবিত্তের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। পরবর্তী বাঙালির থিয়েটারের ক্রমবিকাশে নবোদ্ভূত বাঙালি মধ্যবিত্তের ভূমিকা সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য।
  • তাছাড়া, বণিক ইংরেজের চক্রান্তের কৌশল তো ছিলই; যাতে লেবেডেফ পূর্ণাঙ্গ কাজ করতে পারেননি বা তাঁকে করতে দেওয়া হয়নি। বেনিয়া ইংরেজ ভিনদেশি লেবেডেফের নাট্যাভিনয়ের ব্যবসায়িক সাফল্যকে ঈর্ষার চোখে দেখেছিল। তাঁর বেঙ্গলী থিয়েটার আগুন লেগে পুড়ে যাওয়া নিশ্চয়ই কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা মাত্র নয়। এই ধরনের উদ্যমের এই ধরনের মর্মান্তিক পরিণতি পরবর্তী উৎসাহী ব্যক্তিদের স্বাভাবিকভাবেই ভীতসন্ত্রস্ত ও নিরুদ্যম করে দিতে পারে।

এইসব কারণেই, বোধকরি, তার থিয়েটার পরবর্তীকালে বাংলা নাট্যশালা ও নাট্যাভিনয়ের ধারাবাহিকতা থেকে বিযুক্ত হয়ে পড়েছিল।

ইংরেজি নাট্যশালার আদলে রঙ্গমঞ্চ গড়ে ইংরেজি নাটকের মতো নাটক করাব প্রথম সূত্রপাত বাঙালিদের মধ্যে দেখা গেল, এর পঁয়ত্রিশ বছর পরে, ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে, প্রসন্নকুমার ঠাকুরের বাড়িতে হিন্দু থিয়েটার প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। সেখানে হয়েছিল ইংরেজি ভাষায় নাটক বাঙালিদের দ্বারা। তারপর নবীন বসুর বাড়িতে, ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রী দিয়ে বাংলা নাটকের অভিনয়। এইভাবে কলকাতায় ১৯ শতকের তিরিশের দশকে এসে বাঙালির প্রাসাদমঞ্চে বাংলা নাট্যাভিনয়ের সূত্রপাত হও; ধনী বাঙালির অর্থানুকুল্যে ও উৎসাহে এবং ইংরেজি শিক্ষিত নব্যতরুণদলের উদ্যমে ও আগ্রহাতিশয্যে।

বাঙালির এই অভিনয় প্রচেষ্টা লেবেডেফ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নয়। সমসাময়িককালের চৌরঙ্গী ও সাঁ সুসি প্রভৃতি ইংরেজদের থিয়েটারের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত থেকে, তাদের অভিনয় দেখে, স্কুলকলেজে ইংরেজি নাটক পড়ে, ইংরেজি নাটকে অভিনয় করে, তারা বিলিতি থিয়েটারের মতাে নিজেদের থিয়েটার করতে উদ্বুদ্ধ হলো।

তাহলে লেবেডেফের থিয়েটারের কোনো ঐতিহাসিক মূল্য বা প্রভাব কি পরবর্তী বাঙালির নাট্যপ্রচেষ্টার মধ্যে একেবারেই থাকছে না?

একথা ঠিক, লেবেডেফের সময়ে বাংলা সংবাদপত্র ছিল না, ইংরেজি পত্রিকা ছিল। লেবেডেফকে তাই শুধু ইংরেজি সংবাদপত্রেই বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছিল। বাংলা সংবাদপত্র থাকলে তিনি নিশ্চয়ই বাংলা ও ইংরেজি দুটি কাগজেই তাঁর নাট্যাভিনয়ের বিজ্ঞাপন দিতেন, তার দুই ধরনের দর্শকের জন্যই। লেবেডেফের পরে পরে বাঙালির কোনো নাট্যপ্রচেষ্টা হয়েছে কিনা তার কোনো লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায় না, ঐ বাংলা পত্রিকার অভাবে। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে প্রথম বাংলা সাময়িকপত্র ‘দিগদর্শন’ প্রকাশ পায়। ওই বছরেই মে মাসে সাপ্তাহিক বাংলাপত্র ‘সমাচারদর্পণ’ প্রকাশিত হয়।

১৮২১ খ্রিস্টাব্দে অভিনীত ‘কলিরাজার যাত্রা’ এবং ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত ‘কামরূপ কামলতা যাত্রা’— দুটিকে অনেকে নতুন ধরনের যাত্রা বা ‘নাটকের অনুরূপ যাত্রা’ বলে মনে করেছেন। লেবেডেফ বাংলায় যে নাট্যাভিনয়ের সূত্রপাত করেন, এগুলিতে তারই অনুসরণ ঘটেছে বলে মনে করা যেতে পারে।

রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে লেবেডেফ ও বেঙ্গলী থিয়েটারের অবদান

লেবেডেফের নাট্যানুষ্ঠানের যে কৃতিত্ব পরবর্তী বাংলা নাট্যাভিনয়ের ধারায় গ্রহণ করা যেতে পারে সেগুলি সূত্রাকারে উল্লেখ করলে এই রকম দাঁড়ায়—

  • লেবেডেফের ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’ প্রথম বঙ্গীয় নাট্যশালা। ইংরেজ ও রুশ থিয়েটারের মিশ্রণে এই রঙ্গালয় গঠিত হয়েছিল। তিনি বঙ্গীয় নাট্যশালার জনক।
  • নতুন থিয়েটারে অধিকাংশ ‘বাংলায় লিখিত’ নাটকের প্রথম অভিনয়। উৎকৃষ্ট হলেও প্রথম। ইতিহাসগত দিক দিয়ে তা অবশ্য স্মরণীয়।
  • সব বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রী দিয়ে নাট্যাভিনয়।
  • বাঙালির নাট্যাভিনয়ে প্রথম নারী ভূমিকায় অভিনেত্রীদের আবির্ভাব। সমসাময়িক ও পরবর্তী বাঙালির যাত্রাভিনয়গুলিতে অভিনেত্রী নেওয়ার পেছনে নিঃসন্দেহে লেবেডেফ প্রভাব বিস্তার করেছেন। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে নবীন বসুর ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটকাভিনয়ে অভিনেত্রী গ্রহণ, সেই প্রভাবের সূত্রেই এসেছে, এমন মনে করা যেতে পারে। লেবেডেফ ইংরেজের চক্রান্তে ব্যর্থ মনোরথ না হলে, বোধকরি, ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের অনেক আগেই বাংলা থিয়েটারে অভিনেত্রীরা ধারাবাহিকভাবে এসে যেতেন।
  • বেঙ্গলী থিয়েটারে অভিনয় হয়েছিল বিদেশী রঙ্গমঞ্চের মডেলে। তৎকাল প্রচলিত বাঙালির যাত্রার অনুসরণে নয়।
  • এর আগে যাত্রায় প্রবেশ প্রস্থান ছিল না, অঙ্কবিভাগ থাকলেও দৃশ্যভাগ ছিল এবং রঙ্গমঞ্চের অন্য কোনো বিধি ব্যবস্থা ছিল না। লেবেডেফের বাংলা নাটকে ইংরেজি ধরনের প্রবেশ প্রস্থান, মঞ্চ ও দৃশ্যবিভাগ এবং মঞ্চের নির্দেশ ছিল। লেবেডেফের নাটকেই বিদেশী রীতির প্রথম অনুবর্তন লক্ষ করা গেল।
  • এই থিয়েটারের ফলে বাঙালি জানতে পারলো যে, যাত্রা জগতের বাইরেও অন্য ধরনের প্রমোদ-ব্যবস্থা থাকতে পারে।
  • তাঁর প্রহসন বাংলা প্রহসনের রচনায় প্রেরণাস্থল হিসেবে গণ্য হতে পারে।
  • তৎকালে প্রচলিত যাত্রা ও কবিগানের বিষয়বস্তু ছিল পৌরাণিক দেবমাহাত্ম্য বিষয়ক। লেবেডেফ সামাজিক ব্যঙ্গ-প্রহসনের নাটক বাংলায় প্রথম অভিনয় করেন। তার পরবর্তী যাত্রাগুলিতে অনেকসময় পৌরাণিক বিষয় ছেড়ে সামাজিক ব্যঙ্গ গৃহীত হয়েছে। কলিরাজার যাত্রা উল্লেখযোগ্য।
  • সর্বোপরি, শুধু শাসক ইংরেজের নিজেদেরই থিয়েটার হতে পারে, বাঙালির হতে পারে না—এই হীনতাবোধ থেকে তিনি বাঙালি নাট্যরসিকদের মুক্তি দিয়েছেন। বাংলা নাট্যশালা ও নাটকাভিনয়ের আলোচনায় আমাদের সর্বপ্রথমেই এই রুশদেশবাসী নাট্যব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই হবে।

 

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!