//
//

সাহিত্য ও সভ্যতা প্রবন্ধের স্বরূপ ব্যাখ্যা কর।

  • প্রসঙ্গ: সাহিত্য ও সভ্যতার স্বরূপ বৈশিষ্ট্য।
  • সাহিত্যই মানবহৃদয়ে সেই ধ্রুব অসীমের বিকাশ। ‘সাহিত্য ও সভ্যতা’ প্রবন্ধ অবলম্বনে মন্তব্যদুটি বিচার কর।

রবীন্দ্রনাথ আভিধানিক অর্থে তত্ত্ব প্রতিষ্ঠাকামী দার্শনিক ছিলেন না। তিনি অন্যের চিন্তার দ্বারা যেমন প্রভাবিত হননি, তেমনি অন্যকেও স্বমতে আনার চেষ্টাও করেননি। সাহিত্যের তাৎপর্য’ প্রবন্ধে কবি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন সকল হীনতা দীনতাকে ছাড়িয়ে উঠে যে সাহিত্যে সমগ্রভাবে মানুষের মহিমা প্রকাশ না হয়, তাকে নিয়ে গৌরব করা চলবে না কেননা সাহিত্যে মানুষ আপনারই সঙ্গকে আপনার সাহিত্যকে প্রকাশ করে স্থায়িত্বের উপাদানে। আজকে ফ্যাশনের যুগে সকলেই যখন মনুষ্যত্বের অবমাননা ঘটিয়েছে, তখন এই দিকে সতর্ক করার প্রয়োজন বোধহয় জরুরী হয়ে উঠেছিল, নতুবা বস্তুতন্ত্রের প্রাধান্যের কালে দাঁড়িয়ে বিশ শতকের চার্লস মরগান কখনই বলতেন না— ‘‘An artist is not in the world to crucify humanity but to was its feet.’’

সাহিত্যে মনুষ্যত্বের অবমাননা প্রসঙ্গে কবি ইউরোপীয় সভ্যতার প্রসঙ্গটি স্পষ্ট ভাষায় উত্থাপন করে বলেছেন, বিলেতের কাগজে সাহিত্যরসের অভাব দেখা যাচ্ছে, সেখানে রাজনীতি ও সমাজনীতিই প্রধান স্থান দখল করেছে। ইংলণ্ডে কাজের ভিড় বেশ বেড়ে গেছে। রাজ্য ও সমাজতন্ত্র ক্রমশ জটিল হয়ে পড়ছে। এত বর্তমান অভাব-নিরাকরণ এত উপস্থিত সমস্যার মীমাংসা আবশ্যক হয়েছে, প্রতিদিনের কথা প্রতিদিন এত জমা হচ্ছে যে, যা নিত্য, যা মানবের চিরদিনের কথা, যে সব অনন্ত প্রশ্নের মীমাংসা ভার এক যুগ অন্য যুগের হাতে সমর্পণ করে চলে যায়, মানবাত্মার যে সব গভীর বেদনা এবং গভীর আশার কাহিনী, সে আর উত্থাপিত হবার অবসর পায় না। চিরনবীন চিরপ্রবণ প্রকৃতি তারনিবিড় রহস্যময় অসীম সৌন্দর্য নিয়ে আগের মত তেমনি ভাবেই চেয়ে আছে, চারদিকে সেই শ্যামল তরুপল্লব, কাশের চুপি চুপি রহস্যকথার মতো অরণ্যের সেই মর্মরধ্বনি, নদীর সেই চিরপ্রবাহময় অথচ চির-অবসরপূর্ণ কলগীতি, প্রকৃতির অবিরামনিসিত বিচিত্রবাণী এখনো নিঃশেষিত হয়নি, কিন্তু যার আপিসের তাড়া পড়েছে, কেরানিগিরির সহস্র খুচরো দায় যার শাম্‌লার মধ্যে বাসা বেঁধে কিচিমিচি করে। মরছে, সে বলে ‘দূর করো তোমার প্রকৃতির মহত্ত তোমার সমুদ্র ও আকাশ, তোমার মানবহৃদয়, তোমার মানবহৃদয়ের সহস্রবাহী সুখ দুঃখ ঘৃণা ও প্রীতি, তোমার মহৎ মনুষ্যত্বের আদর্শ ও গভীর রহস্যপিপাসা, এখন হিসাব ছাড়া আর কোনো কথা হইতে পারে না। কবির মনে হয় কল-কারখানার কোলাহলে ইংরেজরা বিশ্বের অনন্ত সংগীতধ্বনির প্রতি মনোযোগ দিতে পারছে না, উপস্থিত মুহূর্তগুলো পঙ্গপালের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে এসে অনন্তকালকে আচ্ছন্ন করেছে।

সাহিত্যের উদ্দেশ্য প্রবন্ধে কবি বলেছেন— বৃষ্টির সঙ্গে সাহিত্যের তুলনা হয় না। এই অসীম সৃষ্টিকার্য অবসরের মতো নিমগ্ন। চন্দ্রসূর্য গ্রহ-নক্ষত্র অপার অবসরসমুদ্রের মধ্যে হাজার কুমুদ কহ্নার পদ্মের মতো ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে উঠেছে। কাজের শেষও নেই, অথচ তাড়াও নেই। পদ্মের একটি শুভ প্রভাতের জন্য শুভ্র চামেলি সৃষ্টির কোন্ অন্তঃপুরে অপেক্ষা করছে। সাহিত্যও সেইরকম অবসরের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে। এর জন্য অনেকখানি আকাশ, অনেকখানি সূর্যালোক, অনেকখানি শ্যামল ভূমির আবশ্যক। কার্যালয়ের শান বাঁধানো মেজে খুঁড়িয়া যেমন মাধবীলতা উঠে না, তেমনি সাহিত্যও উঠে না।

ক্রমশঃ প্রসারমান বিস্তৃত রাজ্যভার, জটিল, কর্তব্যশৃঙ্খল, অবিশ্রাম দলাদলি ও রাজনৈতিক কুটতর্ক, বাণিজ্যের জুয়াখেলা, জীবিকা সংগ্রাম, রাশীকৃত সম্পদ ও অগাধ দারিদ্রের একত্র অবস্থানে সামাজিক সমস্যা— এইসব নিয়ে ইংরেজ মানবহৃদয় ভারাক্রান্ত। তার মধ্যে স্থানও নেই, সময়ও নেই। সাহিত্য সম্বন্ধে যদি কোন কথা থাকে তো সংক্ষেপে সারো, আরও সংক্ষেপ করো। প্রাচীন সাহিত্য ও বিদেশী সাহিত্যের সার-সংকলন করা যায় না। ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞানের সার-সংকলন করা যেতে পারে। মালতীলতাকে হামানদিস্তায় ঘুটিয়া তাল তাল পাকালে সেই তালটাকে মালতীলতার সার-সংকলন বলা যেতে পারে না। মালতীলতার হিল্লোল, তার বাহুর বন্ধন, তার প্রত্যেক শাখা প্রশাখার ভঙ্গিমা, তার পূর্ণযৌবনভার, হামানদিস্তার মধ্যে খুঁটিয়া ভোলা ইংরেজেরও অসাধ্য।

প্রায়ই দেখা যায়, অতিরিক্ত কাজের বোঝা যার কাঁধে থাকে সে কিছু নেশার বশ হয়। যেনতেন প্রকারেণ একটু অবসর পেলেই, উৎকৃষ্ট আমোদ ছাড়া তার তৃপ্তি হয় না। যেমন উৎকট কাজ তেমনি উৎকট অবসর, কিন্তু বিশুদ্ধ সাহিত্যের মধ্যে নেশার তীব্রতা নেই। ভালো সন্দেশে যেমন চিনির আতিশয্য থাকে না, তেমনি উন্নত সাহিত্যে প্রচণ্ড বেগ এবং প্রশান্ত মাধুরী থাকে বটে, কিন্তু মাদকতা থাকে না। এইজন্য সর্বদা ব্যস্ত লোকের কাছে সাহিত্যের আদর নেই। নেশা চাই। ইংলণ্ডে দেখো খবরের নেশা। সে নেশা আমরা কল্পনা করতে পারি। খবরের জন্য কাড়াকাড়ি তাড়াতাড়ি, যে খবর দু’ঘণ্টা পরে হলে কারুর কোন ক্ষতি হয় না, সেই খবর দু ঘন্টা আগে জোগাবার জন্য ইংলণ্ড ধনপ্রাণ অকাতরে বিসর্জন দিচ্ছে। সমস্ত পৃথিবী ঝেঁটিয়ে প্রতিদিনের খবরের টুকরো ইংলণ্ড দরজার কাছে পাকার করে তুলছে। দুর্ভাগ্যক্রমে সাহিত্যে কোনো খবর পাওয়া যায় না। কারণ, যে সকল খবর সকলেই জানে অধিকাংশ সাহিত্য তাই নিয়ে।

ইংলণ্ডে বিশ্বব্যাপী কারখানা এবং দেশব্যাপী দলাদলি নিয়ে না জানি কী মত্ততা। সেখানে যদি বর্তমানই দানবাকার ধারণ করে নিত্যকে গ্রাস করে, তাতে আর আশ্চর্য কী। বর্তমানের সঙ্গে অনুরাগভরে সংলগ্ন হয়ে থাকা যে মানুষের স্বভাব এবং কর্তব্য তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। তাই বলে বর্তমানের আতিশয্যে মানুষের সমস্তটা চাপা পড়ে যাওয়া কিছুকায়। গাছের কিছু অংশ মাটির নিচে থাকা জরুরী বলে যে সমস্ত গাছটাকে মাটির নীচে পুঁতে ফেলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তার পক্ষে অনেকখানি ফাঁকা অনেকখানি আকাশ প্রয়োজন। যে মাটির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে সেই মাটি খুঁড়েও মানুষকে অনেক উর্দ্ধে উঠতে হবে, তবেই তার মনুষ্যত্বসাধন হবে। কিন্তু ক্রমাগতই যদি সে ধূলি-চাপা পড়ে, আকাশে উঠবার যদি সে অবসর না পায়, তবে তার কী দশা।

যেমন বদ্ধঘরে থাকলে মুক্ত বাতাসের প্রয়োজন সর্বাধিক, তেমনি সভ্যতার সহস, অবস্থাতেই বিশুদ্ধ সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা বেশি হয়। সভ্যতার শাসন-নিয়ম সভ্যতার কৃত্রিম শৃঙ্খল যতই আঁট হয়— হৃদয়ে হৃদয়ে স্বাধীন মিলন, প্রকৃতির অনন্ত ক্ষেত্রের মধ্যে, কিছুকালের জন্য রুদ্ধ হৃদয়ের ছুটি, ততই নিতান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। সাহিত্য সেই মিলনের স্থান, সেই খেলার গৃহ, সেই শান্তিনিকেতন। সাহিত্যই মানবহৃদয়ে সেই ধ্রুব অসীমের বিকাশ। অনেকে ভবিষ্যদ্বাণী প্রচার করেন এই বলে যে, সভ্যতা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের বিনাশ হবে। তা যদি হয় তবে সভ্যতারও বিনাশ হবে। কেননা শুধুমাত্র পাকা রাঙ্গা যে মানুষের পরে প্রয়োজন তা নয়, শ্যামল ক্ষেত্র তার চেয়ে অধিক প্রয়োজন, প্রকৃতির বুকের উপর পাথর ভেঙে আগাগোড়া সমস্তটাই যদি পাকা রাস্তা করা যায়, কাঁচা কিছুই থাকে না তবে সভ্যতার অতিশয় বৃদ্ধি হয় সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই অতিবৃদ্ধিতেই তার বিনাশ। লণ্ডন শহর অত্যন্ত সভ্য—একথা কে না বলবে, কিন্তু এই লণ্ডনরূপী সভ্যতা যদি দৈত্যশিশুর মতো বাড়তে বাড়তে সমস্ত দ্বীপটাকে তার ইষ্টক কঙ্কালের দ্বারা চেপে বসে, তবে সেখানে মানুষ কেমন করে টিকে থাকবে। কারণ মানুষ তো বিশেষ বিশেষ পণ্ডিতদের দ্বারা সৃষ্ট কল নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!