//
//

সাহিত্যিক মহাকাব্যের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা কর।

সাহিত্যিক মহাকাব্য

আধুনিককালে আধুনিক কবির মহাকাব্যিক প্রয়াসের নাম হল সাহিত্যিক মহাকাব্য বা Epic of art বা literary Epic। সাহিত্যিক মহাকাব্য একক প্রয়াসেই সৃষ্ট বলে মন্ময়তার লক্ষণ তাতে প্রকট। সেই হিসাবে আদি মহাকাব্যের তুলনায় কাব্যিক উৎকর্ষ এতে থাকাই স্বাভাবিক। একটি সার্থক সাহিত্যিক মহাকাব্য যেমন একদিকে আদি মহাকাব্যের কিছুটা আভাস দেয়, অন্যদিকে আধুনিক মহাকাব্যেরও কিছুটা আভাস দেয়, যেমন ‘রামায়ণ’ মহাকাব্যের অংশবিশেষ অবলম্বন করে মধুসূদন দত্ত রচনা করলেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। কিন্তু রচনার গুণেই তা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রেরণা হয়ে থাকল হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বৃত্রসংহার’ কাব্য। তবে স্বাভাবিকভাবেই আদি মহাকাব্যের সঙ্গে সাহিত্যিক মহাকাব্যের কিছুটা সাদৃশ্য আছে, কারণ আদি মহাকাব্যের প্রতি দৃষ্টি রেখেই আধুনিক মহাকাব্য গড়ে ওঠে, আবার সময় মানসিকতা ও যুগরুচির কারণে তাদের মধ্যে ভিন্নতাও দেখা দেয়।

সাহিত্যিক মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্য

  • সাহিত্যিক মহাকাব্য সাধারণত বিষয়বস্তু সংগ্রহ করে আদি মহাকাব্য, প্রাচীন বীরগাথা কিংবা লোকগাথা থেকে। আদি মহাকাব্যের গঠন অনুসরণ করেই তার কাব্যদেহ গঠিত হয়।
  • পুরাণ বা প্রাচীন ইতিহাস থেকে উপাদান সংগৃহীত হলেও সেই প্রাচীন উপাদান সাহিত্যিক মহাকাব্যে অমর পুরাতত্ত্ব থাকে না। কবির আধুনিক মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে তা সম্পূর্ণ নতুন সৃষ্টি হয়ে ওঠে।
  • আদি মহাকাব্যের পৌরাণিক উপাদানের মধ্যে যে উদ্দাম জীবনবোধ, যে অকৃত্রিম সারল্য আছে, তার তুলনায় সাহিত্যিক মহাকাব্য অনেকটাই স্তিমিত, পরিশীলিত পুরাতত্ত্বের চর্চা মনে হতে পারে।
  • সাহিত্যিক মহাকাব্যে মানুষ এবং একমাত্র মানুষই নায়কত্ব করতে পারে। তার নায়ক হবার জন্য দেবোপম গুণের প্রয়োজন হয় না, সাধারণ মানবিক গুণ নিয়েই সে নায়ক হতে পারে। যখন দেবতাই হয়ে ওঠেন সাহিত্যিক মহাকাব্যের নায়ক—তখন কিন্তু তাঁকে দেবতা হিসাবে নায়কত্ব দান করা হয় না, মানুষ হিসাবেই সে মর্যাদা তিনি পান। নবীনচন্দ্র সেনের ‘ত্রয়ী’ কাব্যে এমন দৃষ্টান্ত সুপ্রতিষ্ঠিত, শ্রীকৃষ্ণ এখানকার নায়ক, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে এমনভাবে এখানে চিত্রিত করা হয়েছে আদৌ সে দেবতা নন, একজন দক্ষ ও কূট রাজনীতিবিদ মাত্র যার উদ্দেশ্য ছিল খণ্ড খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত হীনবল ভারতবর্ষে একটা বিরাট যুদ্ধ বাধিয়ে তাদের এক রাজার অধীনে এনে সংহত করা, খণ্ডিত ভারতবর্ষকে এক মহাভারতে পরিণত করা।
  • আদি মহাকাব্য একজন কবি রচনা করলেও তাকে বহু লোককবির যৌথ কীর্তি আখ্যা দেওয়া যায়। কাব্যটিকে বলা যায় জাতীয় মহাকাব্য। কিন্তু সাহিত্যিক মহাকাব্য একক কবির রচনা, তার নিন্দা প্রশংসার সব কিছুই কবি একা আত্মসাৎ করতে পারেন, অন্য কেউ নয়। কাব্যটিকে তারই সৃষ্ট সম্পদ বলা যায়। জাতীয় মহাকাব্য নয়।
  • বস্তুধর্মিতা মহাকাব্যের বিশিষ্ট লক্ষণ হলেও সাহিত্যিক মহাকাব্য তা নয়—কবিকে পরোক্ষভাবে প্রায় সর্বত্র খুঁজে পাওয়া যায় তার কাব্যে।
  • সাহিত্যিক মহাকাব্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আলংকারিকদের বিধিবিধান মেনে চলে। না, ফলে সেইসব নিয়মের প্রেক্ষিতে বিচার চলে না, অবশ্য কবিরা যে সব নিয়মের কথা। জেনেই মহাকাব্য রচনায় অগ্রসর হন তার প্রমাণ তাঁদের মহাকাব্যে খুঁজে পাওয়া যায়।
  • ভাষায় উৎকর্ষ সাহিত্যিক মহাকাব্যে প্রবলভাবেই থাকে। বরং ব্যক্তিগত কীর্তি বলে। সেদিকে কবি অধিকতর যত্নবান হন।

সব মিলিয়ে বলতে হয় সাহিত্যিক মহাকাব্য একালের সৃষ্টি বলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র তাতে বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়। যেখানে ক্রমেই রচনা হয় যুক্তির বেড়াজাল।

একটি সার্থক সাহিত্যিক মহাকাব্য

সাহিত্যিক মহাকাব্য মূলত একালের সৃষ্টি। বহু কবি একালের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রাচীনের প্রেক্ষাপটকে অবলম্বন করে অল্পবিস্তর সাহিত্যিক মহাকাব্য লিখতে সমর্থ হয়েছিল। যে সকল মহাকাব্য রচিত হয়েছিল তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থানীয় ‘মেঘনাদবধ কাব্য’।

  • কবি মেঘনাদবধ কাব্যের বিষয়বস্তু সংগ্রহ করেছিলেন আদিকবি বাল্মীকির রামায়ণ মহাকাব্য থেকে। রাবণের বীরপুত্র মেঘনাদকে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ঢুকে লক্ষ্মণ অন্যায় রণে কীভাবে হত্যা করেন, সেই অংশই কবি তাঁর কাব্যের বিষয়বস্তু হিসাবে নির্বাচন করেছেন। সুতরাং কাব্যের বিষয় মহাকাব্যের উপযোগী সন্দেহ নেই।
  • এ কাব্যের কাহিনি রামায়ণ থেকে সংগৃহীত হলেও কবির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পূর্ণ নতুন হয়ে উঠেছে এবং সবচেয়ে বড়ো কথা তা এক মৌলিক ও স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করেছে।
  • সাহিত্যিক মহাকাব্যে জীবনের দুর্মম আবেগ ও আদিম প্রবৃত্তি যে অনেকটা সংহত হয়ে আসে, মেঘনাদবধ কাব্যে তাঁর নিদর্শন আছে। রামায়ণের অন্ধমুনির দুর্বার ক্রোধ, কৈকেয়ীর অনাবৃত ঈর্ষা বা লক্ষণের প্রতি সীতার পুরুষ বচন প্রভৃতির যে দৃষ্টান্ত আছে—‘মেঘনাদবধ কাব্য’ তার তুলনায় অনেক সংযত।
  • মধুসূদন তাঁর ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের পৌরাণিক নায়িকাদের মানবিক অনুভূতি সম্পন্ন নারী করে তুলেছেন, সেই ভাবেই ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র নারী চরিত্রগুলিকে মানবিক করে তুলতে পেরেছিলেন। এবং সেটাই এ কাব্যের প্রতি আধুনিক পাঠকের আকর্ষণের প্রধান কারণ।
  • ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নিঃসন্দেহে একক সৃষ্টি। এটি যে শুধু মধুসূদন দত্তের সৃষ্টি তাই নয়, এ কাব্য তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি এবং এ কাব্য তিনি ছাড়া আর কেউ রচনা করতে পারতেন—এমন বোধমনস্ক ও সচেতন পাঠকের মধ্যে গড়ে ওঠে।
  • মহাকাব্যকে তন্ময় কবিতার অন্তর্ভুক্ত করা হয় কিন্তু সাহিত্যিক মহাকাব্যকে মন্ময় কবিতার ধারায় অভিষিক্ত। কারণ এ কাব্য পাঠে গভীর মনঃসংযোগের প্রয়োজন, নতুবা এর আসল রস গ্রহণে বঞ্চিত হতে হয়। মেঘনাদবধ তারই দৃষ্টান্ত।
  • সাহিত্যিক মহাকাব্য যেহেতু যুক্তি ও বিচার বিশ্লেষণের দ্বারা যেহেতু তার কাব্য সৌন্দর্য প্রকাশ পায়, সেহেতু মেঘনাদবধ কাব্য সম্পূর্ণরূপে আলংকারিক প্রদত্ত মহাকাব্যের আঙিনায় অধিষ্ঠিত না করে তাকে কেবল যুক্তি দ্বারা বিশ্লেষণ করলে তার আসল স্বরূপ ফুটে উঠবে।
  • ভাষার উৎকর্ষ মেঘনাদবধ কাব্যে আছে। মহাকাব্যিক নির্দেশমতো মধুসূদন বিভিন্ন সর্গে বিভিন্ন ছন্দের ব্যবহার করেননি বটে, কিন্তু মহাকাব্যের সম্পূর্ণ উপযোগী অমিত্রাক্ষর নামে যে যুগান্তকারী ছন্দরীতির প্রবর্তন করেন, কেবল সেই জন্যই তিনি দীর্ঘকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

সুতরাং সাহিত্যিক মহাকাব্যের বিভিন্ন লক্ষণের আলোকে মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’কে সম্ভবত সার্থক সৃষ্টি হিসেবে স্বীকৃতি দান করা যায়।

তথ্যসূত্র:

কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্তDownload
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাসDownload
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরীDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাসDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যালDownload
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাসDownload
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
সাহিত্যের রূপরীতি ও অন্যান্য – কুন্তল চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য ও সমালোচনার রূপরীতি – উজ্জ্বলকুমার মজুমদারDownload
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তDownload
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দীDownload
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যালDownload
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেনDownload
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!