//
//

‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধের মূল ভাব ব্যক্ত কর।

  • সাহিত্যের উদ্দেশ্য নাই।
  • সাহিত্যই সাহিত্যের উদ্দেশ্য।
  • আনন্দই তাহার কারণ, এবং আনন্দই তাহার উদ্দেশ্য।
  • সাহিত্য সেইরূপ সৃজনধর্মী; দর্শন বিজ্ঞান প্রভৃতি নির্মাণধর্মী। সৃষ্টির ন্যায় সাহিত্য সাহিত্যের উদ্দেশ্য। ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধ অবলম্বনে মন্তব্যটি বিচার কর।

সাহিত্যের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন জায়গায় তার মতামত ব্যক্ত করে যে সব মূল্যবান বক্তব্যগুলি রেখেছেন, সেগুলিকে একত্রিত করলেই আমাদের আলোচ্য প্রসঙ্গণ্ডলির তাৎপর্য স্পষ্ট হবে। যেমন ‘কাব্য: স্পষ্ট ও অস্পষ্ট’ প্রবন্ধে বলেছেন—সাহিত্যের কাজ আনন্দদান এবং মানব হৃদয়ের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন। তারপর সাধনায় বললেন—সাহিত্যে উদ্দেশ্য মানব প্রকাশ। প্রকৃতি ও সৌন্দর্য-বর্ণনা উপলক্ষ্যমাত্র। কাব্য মানুষকে ফুটিয়ে তোলে, কাব্য মানবজীবনের সমালোচনা। অর্থাৎ কবির কাজ শুধু সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর হাতে সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে তুলে ধরা। এই দেবী জগতের মধ্যে বিচিত্ররূপে প্রকাশিত হলেও অন্তরে সে একাকী। সুতরাং কাব্যের উদ্দেশ্য আনন্দদান বা কাব্য-সাহিত্য মানবজীবনের প্রতিবিম্ব অথবা সাহিত্যের উদ্দেশ্য মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ স্থাপন—একথা ‘সাধনা’ পর্বের বিভিন্ন প্রবন্ধে ব্যক্ত করলেও, ‘চিত্রা’তেই কবি আবার সৌন্দর্য বর্ণনাকেই কবির উদ্দেশ্য বলে চিহ্নিত করেছেন।

এখন সর্বাগ্রে দেখা যাক সাহিত্যের লক্ষণটি কী? সাহিত্যের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে মানবজীবনের সম্পর্ক। মানুষের মানসিক জীবনটা কোনে? যেখানে আমাদের বুদ্ধি এবং হৃদয়, যেখানে আমাদের বুদ্ধি প্রবৃত্তি এবং রুচি সম্মিলিতভাবে কাজ করে। এক কথায়, যেখানে আদত মানুষটি আছে। সেইখানে সাহিত্যের জন্ম লাভ হয়। মানুষ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় খণ্ড খণ্ডভাবে প্রকাশ পায়। সেই খণ্ড অংশগুলি বিজ্ঞানদর্শন প্রভৃতি রচনা করে। পর্যবেক্ষণকারী মানুষ বিজ্ঞান রচনা করে, এবং সমগ্র মানুষটি সাহিত্যরচনা করে। এই প্রসঙ্গে সৌন্দর্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সাহিত্য’ প্রবন্ধে। বলছেন— এ কথা একটা চিরসত্য যে, যাদের কল্পনাশক্তি আছে তারা সৌন্দর্যকে নির্জীব ভাবে দেখতে পারে না। তারা অনুভব করে যে, সৌন্দর্য যদিও বস্তুকে অবলম্বন করে প্রকাশ পায়, কিন্তু তা যেন বস্তুর অতীত, তার মধ্যে যেন একটা মনের ধর্ম আছে। এইজন্য মনে হয় সৌন্দর্যে যেন একটা ইচ্ছাশক্তি, একটা আনন্দ, একটা আত্মা আছে। ফুলের আত্মা যেন সৌন্দর্যে বিকশিত প্রফুল্ল হয়ে ওঠে, জগতের আত্মা যেন অপার বহিসৌর্ন্দযে আপনাকে প্রকাশ করে। অন্তরের অসীমতা যেখানে বাহিরে আপনাকে প্রকাশ করতে পেরেছে সেইখানেই যেন সৌন্দর্য; সেই প্রকাশ যেখানে যত অসম্পূর্ণ সেইখানে তত সৌন্দর্যের অভাব, রূঢ়তা, জড়তা, চেষ্টা, দ্বিধা ও সর্বাঙ্গীণ অসামঞ্জস্য।

অন্যদিকে বিজ্ঞানশিক্ষা আমাদের প্রাণরক্ষা এবং জীবনযাত্রায় অনেক সাহায্য করে ঠিকই, কিন্তু সে সাহায্য আমরা পরের কাছ থেকে নিতে পারি। ডাক্তারের কাছ থেকে স্বাস্থ্যরক্ষার উপদেশ, কেমিস্টের কাছ থেকে ওষুধপত্র, যান্ত্রিকের কাছ থেকে যন্ত্রমূল্য দিয়ে নিতে পারি। কিন্তু সাহিত্য থেকে যা পাওয়া যায় তা আর কারও কাছ থেকে ধার করে কিংবা কিনে নিতে পারিনে। সেটা আমাদের সমস্ত প্রকৃতি দিয়ে আকর্ষণ করে নিতে হয়, সেটা আমাদের সমস্ত মনুষ্যত্বের পুষ্টি সাধন করে। কিন্তু সমাজের অন্যান্য হাজার উপকার ছেড়ে দিয়ে, কেবলমাত্র তার সান্নিধ্য, মনুষ্যসাধারণের একটা আকর্যণ, চারদিকের হাসিকান্না ভালোবাসা বাক্যালাপ না পেলে আমরা যে মানুষ হতে পারতুম না সেটা আমরা ভুলে যাই আমরা ভুলে যাই সমাজ নানারকম দুষ্পাচ্য কঠিন আহারকে পরিপাক করে সেটাকে জীবনরসে পরিণত করে আমাদের প্রতিনিয়ত পান করাচ্ছে। সাহিত্য সেইরকম মানসিক সমাজ। সাহিত্যের মধ্যে মানুষের হাসিকান্না, ভালোবাসা, বৃহৎ মানুষের সংস এবং উত্তাপ, বহুজীবনের অভিজ্ঞতা, বহুবর্ষের স্মৃতি, সবসুদ্ধ মানুষের একটা ঘনিষ্ঠতা পাওয়া যায়। সেইটা বিশেষ কী উপকার করে পরিষ্কার করে বলা কঠিন। তবে বলা যায় সাহিত্য আমাদের সর্বাঙ্গীণ মনুষ্যত্বকে পরিস্ফুট করে তোলে।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— ‘‘বিশুদ্ধ সাহিত্যের মধ্যে উদ্দেশ্য বলিয়া যাহা হাতে ঠেকে তারা আনুষঙ্গিক। এবং তাহাই ক্ষণস্থায়ী। যাহার উদ্দেশ্য আছে তাহার অন্য নাম-কোনো একটা বিশেষ তত্ত্ব নির্ণয় বা কোনো একটা বিশেষ ঘটনা বর্ণনা যাহার উদ্দেশ্য তাহার লক্ষণ অনুসারে তাহাকে দর্শন বিজ্ঞান বা ইতিহাস বা আর কিছু বলিতে পারো কিন্তু সাহিত্যের উদ্দেশ্য নাই।’’ কবির আরও বক্তব্য ও ঐতিহাসিক রচনাকে কখন সাহিত্য বলব? যখন জানবো যে তার ঐতিহাসিক অংশটুকু অসত্য বলে প্রমাণ হয়ে গেলেও তা বেঁচে থাকতে পারে। অর্থাৎ যখন জানব ইতিহাস উপলক্ষমাত্র, লক্ষ্য নয়। দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতি অন্য বিভাগ সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। কবির মতে সৃষ্টি উদ্দেশ্য পাওয়া যায় না, নির্মাণের উদ্দেশ্য পাওয়া যায়। ফুল কেন ফোটে তা কার সাধ্য অনুমান করে, কিন্তু ইটের পাঁজা কেন পোড়ে, সুরকির কল কেন চলে, তা সকলেই জানে। সাহিত্য সেইরূপ সৃজনধর্মী ; দর্শন বিজ্ঞান প্রভৃতি নির্মাণধর্মী। সৃষ্টির ন্যায়, সাহিত্যই সাহিত্যের উদ্দেশ্য।

যদি কোনো উদ্দেশ্য না থাকে তবে সাহিত্যে লাভ কী। যাঁরা সকলের চেয়ে হিসেব ভালো বোঝেন তারা এরূপ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন। উত্তর দেওয়া সহজ নয়। গোটাকতক সন্দেশ খেলে যে রসনার তৃপ্তি ও উদরের পূর্তি-সাধন হয় তা প্রমাণ করা সহজ, যদি অজ্ঞানবশত কেউ প্রতিবাদ করে তবে তার মুখে দুটো সন্দেশ পুরে তৎক্ষণাৎ তার মুখ বন্ধ করা যায়। কিন্তু সমুদ্রতীরে থাকলে যে এক বিশাল আনন্দ অলক্ষ্যে শরীর-মনের। মধ্যে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যবিধান করে তা হাতে হাতে প্রমাণ করা যায় না।

সাহিত্যের প্রভাবে আমরা হৃদয়ের দ্বারা হৃদয়ের যোগ অনুভব করি, হৃদয়ের প্রবাহ রক্ষা হয়; হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয় খেলাতে থাকে, হৃদয়ের জীবন ও স্বাস্থ্য-সঞ্চার হয়। যুক্তিশৃঙ্খলের দ্বারা মানবের বুদ্ধি ও জ্ঞানের ঐক্যবন্ধন হয়, কিন্তু হৃদয়ে হৃদয়ে বাঁধার তেমন কৃত্রিম উপায় নেই। সাহিত্য স্বত উৎসারিত হয়ে সেই যোগসাধন করে। সাহিত্য অর্থেই একত্র থাকার ভাব মানবের সঙ্গে থাকার ভাব—মানবকে স্পর্শ করা, মানবকে অনুভব করা। সাহিত্যের প্রভাবে হৃদয়ে হৃদয়ে শীতাতপ সঞ্চারিত হয়, বায়ু প্রবাহিত হয়, ঋতুচক্র ফিরে, গন্ধ গান ও রূপের হাট বসে যায়। উদ্দেশ্য না থেকে সাহিত্যে এমন সহস্র উদ্দেশ্য সাধিত হয় বন্ধুতে বন্ধুতে মিলন হলে কত বাজে কথাই আলোচনা হয়। তাতে হৃদয়ের যেমন বিকাশ হয়, কত হাসি, কত আলাপ, কত আনন্দ হয়। পরস্পরের নয়নের হর্যজ্যোতির সংগে মিশে সূর্যালোক কত মধুর বলে মনে হয়। বিষয়ীলোকের পরামর্শমত কেবলই যদি কাজের কথা হয়, সকল কথার মধ্যেই যদি কীটের মতো উদ্দেশ্য ও অর্থ লুকিয়ে থাকে, তবে কোথায় হাস্যকৌতুক, কোথায় প্রেম, কোথায় আনন্দ! অনেক সাহিত্য এইরকম হৃদয়মিলন উপলক্ষে বাজে কথা এবং মুখোমুখি, দেখাদেখি, কোলাকুলি। সাহিত্য এমন বিকাশ ও স্ফূর্তি মাত্র। সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন—আনন্দই তাহার আদি-অন্ত-মধ্য। আনন্দই তাহার কারণ এবং আনন্দই তাহার উদ্দেশ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!