//
//

‘সাহিত্যের তাৎপর্য’ প্রবন্ধের মূল বক্তব্য নিজের ভাষায় লেখ।

  • চিত্র এবং সঙ্গীতই সাহিত্যের প্রধান উপকরণ‘সাহিত্যের তাৎপর্য’ প্রবন্ধ অবলম্বনে মন্তব্যটি বিচার কর।

আমাদের সামনে পরিদৃশ্যমান জগৎ প্রসারিত হয়ে আছে। এখানে ভালমন্দ, মুখ্য ও গৌণ অঙ্গাঙ্গিভাবে থাকে। প্রকৃতির অপক্ষপাত প্রাচুর্য এই জগতে প্রত্যক্ষগোচর। কিন্তু সেই জগৎ যখন আমাদের মনে প্রবেশ করে, তখন তা রূপান্তরিত হয়। আমাদের নানা অভিজ্ঞতা ও বিচিত্রভাবের স্পর্শে যা স্থূল বাস্তব তা মানসিক হয়ে ওঠে। আমাদের প্রীতি ও বিদ্বেষ, ভীতি ও বিস্ময়, সুখ ও দুঃখের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় হৃদয়বৃত্তির বিচিত্ররসে বাইরের জগৎ এক নতুন রূপ ধারণ করে। স্বভাবতঃ আমরা জগৎকে আমাদের চেতনার স্পর্শে মানসিক ও মানবিক করে নিই।

ইংরেজ কবি এস. টি. কোলরিজ লিখেছিলেন—“O Lady, we receive but what we give, And in our life alone does nature live.’’ যাঁদের হৃদয়বৃত্তির জারকরস পর্যাপ্ত নেই, তাঁরা জগৎকে বস্তু-সীমার বাইরে উপলব্ধি করতে পারেন না। তাঁদের চেতনার রঙে অহল্যার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হয় না। জড় প্রকৃতির এমন দুই একজন লোক আছেন, যাঁদের হৃদয়ের ঔৎসুক্য খুবই সীমিত। তাঁরা এই জগতে বাস করেও প্রবাসী। হৃদয়ের সংকীর্ণ জানলা দিয়ে তাঁরা বিশ্বকে দেখতে পান না। তাঁরা ভর্তৃশাপে বিড়ম্বিত। পক্ষান্তরে সংবেদনশীল, কল্পনাপ্রবণ, সৌভাগ্যবান ব্যক্তি অনেক থাকেন, যাঁদের কাছে প্রকৃতির জগৎ থেমে আমন্ত্রণ আসে। এই পৃথিবীতে, ‘যেথা তার যত ওঠে ধ্বনি’ তা তাঁদের হৃদয় বীণায় সাড়া জাগায়। প্রকৃতির অন্তরের বেদনা প্রকাশের চাঞ্চল্য তাঁদের বাঁশিতে কম্পিত মূৰ্ছনা সৃষ্টি করে। অতএব, ভাবুকের কাছে বাইরের জটিল ও পারম্পর্য বিচ্ছিন্ন জগৎ থেকেও হৃদয়ের অধিগত মানসিক জগতের আকর্ষণ অনেক বেশি। সংবেদনশীল মানব মন যতখানি বাইরের জগৎকে আত্মসাৎ করে নিতে পারেন, তা ঠিক ততখানি সত্য ও সার্থক হয়ে ওঠে।

বাইরের জগৎ নানা সুরে কথা বলে, কারণ সুন্দর ও অসুন্দর, প্রিয় ও অপ্রিয় মিলে এই প্রত্যক্ষগোচর জগৎকে দুর্বোধ্য ও রহস্যময় করে রেখেছে। একেই কবি ‘Burthen of mystery’ রূপে ব্যাখ্যা করেছেন। যে জগৎ বাইরের, তা অত্যন্ত পুরাতন। কিন্তু যুগে যুগে কবিগণের অনুভূতি, মন মনীষার স্পর্শে, হৃদয়ের সংযোগে তা নিত্য নবীন হয়ে কাব্যে প্রতিভাত হয়। তাই জগৎ ও জীবনের সনাতন স্রোত চিরদিনই নবীভূত হয়ে চলেছে। কিন্তু এই যে মানস জগৎ, যা বাস্তব জগতের নব প্রকাশ ও রূপান্তর, তা বাইরে প্রকাশিত হবার আকাঙ্ক্ষা রাখে। মানসজগৎ চিরদিনই সৃষ্টি হয়ে চলেছে, কিন্তু তাকে রূপের সীমায় প্রকাশ করতে না পারলে তা হয় অকৃতার্থ। আমরা হৃদয়ে যা গভীর ভাবে অনুভব করি তা ব্যক্ত করতে চাই। ক্রৌঞ্চীর বিলাপে বাল্মীকি আপন হৃদয়াবেগ প্রকাশ করার জন্য ব্যগ্র হয়ে ছিলেন। তট-অরণ্যের তলে প্রলয়নৃত্যপর মহাদেবের ডমরুধ্বনির মত কলতান সৃষ্টি করে বর্ষাকালে ব্ৰহ্মপুত্ৰনদী যেমন নতুন করে তটভূমি রচনা করতে চায়, বাল্মীকিও সেই রকম তাঁর হৃদয়াবেগকে ভাষার সীমায় বাঁধতে চাইলেন। তাই চিরকালই সাহিত্য রচনার প্রবল আবেগ মানুষের মধ্যে অনুভূত হয়।

সাহিত্য রচনার সময় দুটি বিষয় প্রধান হয়ে ওঠে। একটি হল সাহিত্য স্রষ্টা তাঁর হৃদয় দ্বারা জগৎকে কতখানি গ্রহণ করতে পেরেছেন; অপরটি হল, তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিকে স্থায়ী রূপ দিতে পেরেছেন কি না। কবির কল্পনা যত সার্বভৌম হবে ততই তাঁর রচনার গভীরতা আমাদের আনন্দদান করবে। তাঁর কাব্যে বিশ্বের সীমা বিস্তৃতি লাভ করে আমাদের মনকে সেখানে স্বচ্ছন্দ বিহারের সুযোগ দান করবে। রচনার নৈপুণ্যও সাহিত্যে মর্যাদা লাভ করে। এই নৈপূণ্যের ফলে কবি মনের অনুভূতি বাইরে স্থায়ী রূপ গ্রহণ করে। বাইরের জগৎ কবিমনে আর একটি নতুন জগতে রূপান্তরিত হয়। তাকে এমনভাবে প্রকাশ করতে হয়, যাতে সে অন্যের হৃদয়ে অনায়াসে সঞ্চারিত হতে পারে। এই হৃদয়ের ভাব অন্যের মনে উদ্ৰিক্ত করার জন্য কলা-কৌশলের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। পুরুষের বেশভূষা সাধারণ ও যথাযথ হলেই চলে, কিন্তু নারীর সাজসজ্জায় সুষমা ও পারিপাট্য অপরিহার্য। তাদের আচরণে আভাস-ইঙ্গিত থাকা চাই।

সাহিত্যও সেইরকম নিজেকে সুন্দররূপে ব্যক্ত করার জন্য অলংকার, ভাষা ও ছন্দের আশ্রয় নেয়। সাহিত্যকে শুধু ব্যক্ত করলেই চলে না, রূপের মধ্যে রূপাতীতকে, বক্তব্যের মধ্যে অনির্বচনীয় তাকে প্রকাশ করতে হবে। যা রূপাতীত, অসীম ও অনির্বচনীয় তাকে নিরলংকৃত দর্শন-বিজ্ঞানের ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বাচ্যার্থের অতীত অর্থকে প্রকাশ করতে চায় বলে সাহিত্যের ভাষা ইঙ্গিতবহ বা প্রতীকধর্মী। এই যে গভীর অর্থ, যা হৃদয়বেদ্য, তাকে আলংকারিকেরা ধ্বনি বলেছেন। নারীদেহের অলংকারকে আশ্রয় করে যেমন শ্রী ও হী পরিস্ফুট হয়, তেমনি ছন্দ ও অলংকারকে আশ্রয় করে সাহিত্যের অনির্বচনীয় মাধুর্য প্রকাশিত হয়। ছন্দ ও অলংকার এর উপায় মাত্র, সাহিত্যের যা অনির্বচনীয়তা তা ছন্দে ও অলংকারে আবৃত হয় না।

ভাষার মধ্যে ভাষাতীতকে প্রকাশ করার জন্য সাহিত্য, চিত্র ও সঙ্গীত—এই দুই উপকরণকে গ্রহণ করে থাকে। ভাষায় যে ভাব প্রকাশ করা যায় না, তা চিত্রে সহজে করা যায়। সাহিত্যের ভাবকে উপমা-রূপকের সাহায্যে গঠিত চিত্ররীতির মাধ্যমে প্রত্যক্ষগোচর করা যায়। বৈষ্ণব কবি বলরাম দাস লিখেছেন ‘দেখিবারে আঁখি পাখি ধায়’ এর মাধ্যমে চিত্তের ব্যাকুলতা আশ্চর্য রূপ লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ‘সোনারতরী’র ‘পুরস্কার’ কবিতায় চিত্রের মাধ্যমে অনির্বচনীয় ব্যঞ্জনাকে প্রকাশ করেছেন—

শুধু বাঁশিখানি হাতে দাও তুলি,

বাজাই বসিয়া প্রাণমন খুলি,

পুষ্পের মতো সংগীতগুলি

ফুটাই আকাশ-ভালে

অন্তর হতে আহরি বচন

আনন্দলোক করি বিরচন,

গীতরসধারা করি সিঞ্চন

সংসার-ধূলিজালে।

সঙ্গীতের মাধ্যমে কাব্যের গভীর ভাব ও বচনাতীত মাধুর্যকে প্রকাশ করা যায়। সংগীতের সুরের দ্বারা ভাব-ব্যাকুলতাকে প্রকাশ করা যায়। চিত্র ভাবকে রূপ দান করে ও সংগীত তার মধ্যে গতিবেগ এনে দেয়। চিত্র কাব্যের দেহ ও সংগীত তার আত্মা। বস্তুতঃ বাইরের প্রকৃতি ও মানব চরিত্র মানুষের মনে সর্বদা যে রূপ ধারণ করেছে, যে সুর সৃষ্টি করছে, ভাষায় রচিত সেই চিত্র ও গানই সাহিত্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!